স্কুলগামী কিশোর-কিশোরিদের উপরে করা সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষাগ্রহণের ব্যাপারে রয়েছে তাদের ব্যাপক আগ্রহ। ভবিষ্যতে কোন পেশা নিতে চায়- এমন প্রশ্নের উত্তরে তাদের এই আগ্রহ ফুটে উঠেছে। একইসাথে গবেষণা বলছে, আলোকিত সমাজ গড়তে শিক্ষার যে অবদান রয়েছে সেটি সম্পর্কেও কিশোর-কিশোরিদের স্পষ্ট ধারণা বিদ্যমান। শুধু তাই নয়, স্কুলে শিক্ষার মান এবং পড়াশোনার পরিবেশ নিয়েও তারা যথেষ্ট সচেতন।
চট্টগ্রাম ও সিলেটের সরকারী এবং আধা-স্বায়ত্তশাসিত স্কুলের ৭ম ও ৮ম শ্রেণীর কিশোর-কিশোরিদের উপরে মিশ্র পদ্ধতিতে করা গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যকে মূল্যায়নের মাধ্যমে এমন ফলাফল পাওয়া গেছে। সোমবার (২৪ মে) “অ্যাডোলেসেন্ট এক্সপেরিয়েন্সেস ইন চট্টগ্রাম অ্যান্ড সিলেট : দ্য অ্যাডোলেসেন্ট স্টুডেন্ট প্রোগ্রাম অ্যান্ড কোভিড-১৯ ইমপ্যাক্ট” শীর্ষক ওয়েবিনারে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়।
জরীপে অংশ নেয়া কিশোর-কিশোরিরা কোভিড-১৯ সৃষ্ট বাস্তবতা নিয়েও তাদের মনোভাব তুলে ধরেছে। বন্ধুদের সাথে দূরত্ব, স্কুল বন্ধ এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হওয়ায় তাদের মাঝে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, একঘেয়েমী এবং অবসাদগ্রস্থতা ভর করেছে। “শিক্ষা-সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা”র কারণে তারা সবচেয়ে বেশি চিন্তাগ্রস্থ বলে অধিকাংশ কিশোর-কিশোরি জানিয়েছে। কোভিড-সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট কমাতে তাদের পরিবার খাদ্যাভাসে পরিবর্তন আনায় দৈনিক খাদ্যগ্রহণের পরিমাণ কমেছে এবং সেইসাথে কিশোর-কিশোরিরা তাদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।
ইউকে এইডের অর্থায়নে জেন্ডার অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্স : গ্লোবাল এভিডেন্স (গেজ) কর্মসূচীর আওতায় এই গবেষণাটি করা হয়। কিশোর-কিশোরিদের বিকাশে কি কি উপাদান কাজ করে তা জানার জন্যই মূলত মিশ্র পদ্ধতির মূল্যায়নধর্মী এই গবেষণাটি করা হয়। শুরুতে ইনোভেশন ফর পোভার্টি অ্যাকশান (আইপিএ) ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসজুড়ে (কোভিড-১৯ এর কারণে স্কুল বন্ধের আগে) ২,২২০ জন কিশোর-কিশোরি কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। এরপর ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (বিআইজিডি) ও ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অফ পাবলিক হেলথ (ব্র্যাক জেপিজিএসপিএইচ) ২০২০ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে (কোভিডের কারণে স্কুল বন্ধের মাঝে) ১০০ জন কিশোর-কিশোরি ও তাদের অভিভাবকদের সাক্ষাতকার নেয়।
এই গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফল একটি কার্যকরী অ্যাডোলেসেন্ট স্টুডেন্ট প্রোগ্রাম (এএসপি) তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় ও বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বাস্তবায়িত এই এএসপি’র উদ্দেশ্য হল কিশোর-কিশোরীদের স্কুল ত্যাগের কারণ খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে তাদের শিক্ষা সম্পন্ন করা, মাধ্যমিক স্কুল পর্যায়ে লৈঙ্গিক সমতা নিশ্চিতকরণ এবং যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানদান। ২০২২ সালে চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের সকল স্কুলে এই গবেষণায় প্রাপ্ত সকল কার্যকরী উপাদানগুলোকে ব্যবহার করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
“আমরা যখনুই স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত নেবো, এবং আমি মনে করি দেরি না করে সিদ্ধান্তটি দ্রুত নেয়া দরকার- এমন একটা অবস্থা থেকে আমাদের শুরু করতে হবে যেখানে বেশ বড়রকমের একটি শিক্ষণ ঘাটতি থাকবে, বিশেষত দরিদ্র শ্রেণীর (কিশোর-কিশোরিদের) মাঝে“- বলেছেন ডঃ ইমরান মতিন, নির্বাহী পরিচালক, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (বিআইজিডি), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।
মোঃ সাইয়েদুল ইসলাম, সম্মানিত সচিব, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সরকার, অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, “মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিদিন মনোবিদদের দ্বারা ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টারে (এনটিসিসি) বিনামূল্যে কাউন্সেলিং সেবা প্রদান করছে। শুধু তাই নয়, জাতীয় ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টারসহ দেশজুড়ে থাকা আটটি আঞ্চলিক ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টারে ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে এপর্যন্ত ১৬১০ জন কাউন্সেলিং সেবা নিয়েছে যাদের অধিকাংশই কিশোর-কিশোরি।“
“আমরা যেহেতু স্কুল খুলতে যাচ্ছি, তাই কিশোর-কিশোরীদের সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড-এর সুবিধা অর্জন করা যায় সেটি নিয়েও আমাদের চিন্তাভাবনা করা দরকার।“ বলেছেন টি এম আসাদুজ্জামান, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ এবং সাউথ এশিয়া এডুকেশান গ্লোবাল প্র্যাকটিস অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপের দলনেতা।
ডঃ সাবিনা ফায়েজ রশিদ, ডিন এবং অধ্যাপক, ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অফ পাবলিক হেলথ তাঁর সমাপনী বক্তব্যে বলেন,“এ ধরণের গবেষণা হতে প্রাপ্ত লংগিটিউডিনাল কোয়ালিটেটিভ ডাটা নীতিনির্ধারনে ও কর্মসূচী প্রণয়নে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী।“
গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন ফারহানা আলম, অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেকটর, সেন্টার অফ এক্সিলেন্স ফর জেন্ডার, সেক্সুয়াল অ্যান্ড রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ অ্যান্ড রাইটস (সিজিএসআরএইচআর); ওভারসি’জ ডেভলপমেন্ট ইনস্টিটিউট এর কোয়ালিটেটিভ রিসার্চার সিলভিয়া গুগলিয়েমির পক্ষ থেকে নিকোলা জোনস, পরিচালক-জিএজিই ও প্রিন্সিপ্যাল রিসার্চ ফেলো অফ জেন্ডার, ইকুয়ালিটি অ্যান্ড সোশ্যাল ইনক্লুসন, ওডিআই; মাহিন সুলতান, সিনিয়র ফেলো অফ প্র্যাকটিস ও হেড, জেন্ডার অ্যান্ড সোশ্যাল ট্রান্সফরমেশান ক্লাস্টার, বিআইজিডি; এবং ডঃ জেনিফার সিয়েগার, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর অফ গ্লোবাল হেলথ অ্যান্ড ইকোনোমিক্স, জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি। বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জনাব সৈয়দ মামুনুল আলমও অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।