কর্মচারীদের বেতন-ভাতার সুবিধা বাড়ানো হয়েছে ৪০ শতাংশের ওপরে। কারণ ছাড়াই বেড়েছে মোবাইল নেটওয়ার্ক চার্জ। আয়ের তুলনায় বেড়েছে অস্বাভাবিক। প্রচার, প্রচারণা ও করপোরেট ইভেন্টে স্পন্সর হওয়ার পরিমাণ বাড়িয়েছে। এতে অস্বাভাবিক ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় বছর শেষে লোকসানে পড়ে বিকাশ। অথচ আগের বছরের তুলনায় ২০১৯ সালে ব্যবসা বেড়েছে কোম্পানিটির।
জানা গেছে, দেশের সর্বপ্রথম মোবাইলের মাধ্যমে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ব্র্যাক ব্যাংকের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান বিকাশ। প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ পর্যায় থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে শুরু হয়েছে আর্থিক অনিয়ম। এটি করতে গিয়ে যে যার মতো খাত দেখিয়ে ব্যয় বাড়িয়ে অর্থ সরিয়েছেন। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠানটি বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনেও কয়েকটি খাতে উচ্চ ব্যয় দেখিয়েছে। তাতে স্বচ্ছতা রাখেনি। এ বিষয়ে বিকাশ কর্তৃপক্ষের কাছে স্পষ্টীকরণে প্রশ্ন পাঠানো হলেও উত্তর এড়িয়ে গিয়েছেন তারা।
জানা গেছে, সর্বশেষ হিসাব বছর ২০১৯ সালে বিকাশ লোকসান দেখিয়েছে ৬২ কোটি ৫১ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে মুনাফা করেছিল ১৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা।
তথ্য অনুযায়ী, গত বছরে বিকাশের আয় হয়েছে দুই হাজার ৪১৬ কোটি আট লাখ টাকা, আগের বছরে যা ছিল দুই হাজার ১৭৯ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে ভ্যাট পরিশোধ শেষে গত বছরে দুই হাজার ১২৮ কোটি ১৩ লাখ ও আগের বছরে এক হাজার ৯২৭ কোটি ২১ লাখ টাকা। আয়ে প্রবৃদ্ধি হয় ১১ দশমিক ৯১ শতাংশ।
অন্যদিকে ২০১৯ সালে ব্যয় হয় এক হাজার ৬৬১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। আগের বছরে এর পরিমাণ ছিল এক হাজার ৪০৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা, যা মোট আয়ের ৭৮ শতাংশ। অথচ ২০১৮ সালে ব্যয় হয়েছিল মোট আয়ের ৭২ দশমিক ৮৬ শতাংশ। আয়ের চেয়ে ব্যয় বৃদ্ধি হয়েছে পাঁচ শতাংশীয় পয়েন্টের ওপরে।
জানা গেছে, ২০১৯ সালে পরিচালন লোকসান হয় ১৪৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। আগের বছরে যেখানে পরিচালন মুনাফা ছিল ১৩ কোটি ২১ লাখ টাকা। বিকাশের বর্তমান গ্রাহক তিন কোটি ৮১ লাখ বলে দাবি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে দুই কোটি ২৩ লাখ সক্রিয় অ্যাকাউন্ট। এজেন্ট সংখ্যা হচ্ছে দুই লাখ ৩০ হাজার ৯৪৪টি। এর মধ্যে ৯২ শতাংশই সচল বলে দাবি করেছে বিকাশ।
আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৯ সালে লেনদেন বৃদ্ধি পেয়েছে ১৫ দশমিক ৭০ শতাংশ। গ্রাহক বেড়েছে ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে ২৩ শতাংশ, লেনদেন বেড়েছে ১৫ দশমিক সাত শতাংশ, সার্বিকভাবে এসবের প্রবৃদ্ধি ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ।
২০১৯ সালে নতুন করে যোগ হয় ১৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকার সফটওয়্যার। এছাড়াও অস্বাভাবিক ব্যয় দেখিয়েছে আগাম খাতে। কোম্পানির সাপ্লায়ার বা সরবরাহকারীদের আগাম দিয়েছে ১৪১ কোটি ৭৯ লাখ টাকা, ২০১৮ সালে যা ছিল ৩০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। ২০১৯ সালে ১২ কোটি ৪৩ লাখ টাকার আইটি যন্ত্রপাতি যোগ হয় বিকাশে। ২০১৮ এ খাতে যোগ হয় দুই কোটি ৯৭ লাখ টাকার, যা অস্বাভাবিক বলেই মনে করছেন খাতের বিশেষজ্ঞরা।
ব্যয়ের চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, পরিচালন ও প্রশাসনিক খরচ হয়েছে গত বছরে ৩৯৬ কোটি ৪৭ লাখ টাকা, আগের বছরে যা ছিল ৩২৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে এ খাতে ব্যয় বৃদ্ধি পায় ৭৩ কোটি টাকার ওপরে।
ব্যয়ের মধ্যে ২০১৯ সালে মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেশনস সার্ভিস চার্জ বাবদ ব্যয় করেছে ১৮৩ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে যা ছিল ১৩১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে বৃদ্ধি পায় ৩৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ। এ ব্যয়ের মধ্যে ২০১৯ সালে কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় দেখানো হয় ১৯৭ কোটি ৪২ লাখ টাকা, আগের বছরে যা ছিল ১৪৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা। এক বছরের মধ্যে বৃদ্ধি পায় ৪৯ কোটি টাকা বা ৪০ শতাংশ বেশি।
এর মধ্যে কর্মচারীদের মধ্যে নিয়মিতদের বেতন-ভাতায় ব্যয় দেখানো হয় ১৬০ কোটি ৮৪ লাখ টাকা, আগের বছরে যা ছিল ১১৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ নিয়মিত কর্মচারীদের পেছনেই সবচেয়ে বেশি ৪০ কোটি টাকা বৃদ্ধি করেছে। শতাংশ হিসেবে ৪০-এর ওপরে বেতন-ভাতা বাড়ানো হয় বিকাশের পক্ষ থেকে।
এছাড়া চুক্তিভিত্তিক কর্মচারীদের ক্ষেত্রে ব্যয় দেখানো হয় ২৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা, আগের বছরে যা ছিল ১৭ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ এ খাতে মাত্র বেড়েছে ছয় কোটি টাকা। অপরদিকে আরেক সর্বোচ্চ ব্যয় দেখানো হয় সম্পদের অবচয় খাতে। এ খাতেও ৩৬ কোটি টাকা কমিয়ে আনা হয়। খবর শেয়ারবিজের।
অন্যান্য প্রশাসনিক ব্যয় বেড়েছে ছয় কোটি টাকার ওপরে। এ বিষয়ে বলা হয়, বৈদেশিক মুদ্রায় প্রতিষ্ঠানটি লোকসান হয় ২২ লাখ ১৩ হাজার টাকা। আগের বছরে যা ছিল ৯ লাখ টাকা। এ খাতেও বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। অফিস খরচবাবদ গত বছরে ব্যয় হয়েছে সাত কোটি ৫৪ লাখ টাকা, যা আগের বছরে ছিল এর অর্ধেক অর্থাৎ তিন কোটি ৮৬ লাখ টাকা। বিরোধ নিষ্পত্তিতে ব্যয় বাড়িয়েছে এক কোটি ৩০ লাখ টাকা। অথচ পয়েন্ট অব সেল সামগ্রীতে ব্যয় বেড়েছে মাত্র পাঁচ কোটি টাকা।
বিকল্প চ্যানেল বাবদ বেড়েছে ছয় কোটি টাকা। গত বছরে বিজ্ঞাপনে ব্যয় করে ৯২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা, যা আগের বছরে ছিল ৬৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে ২৭ কোটি টাকা বাড়ায় বিজ্ঞাপনে। ২০১৯ সালে করপোরেট ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টে ব্যয় করে ১৪ কোটি ৯১ লাখ টাকা; যা আগের বছরে ছিল ১০ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এ খাতেও পরিচিত প্রতিষ্ঠানের পেছনে ব্যয় করা হয়।
অস্বাভাবিক ব্যয়, সাপ্লায়ারদের অতিরিক্ত আগাম অর্থ দেয়ার কারণ, কমিউনিকেশন খাতে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় ও ব্যবসা বেশি হওয়ার পরও কেন লোকসান গুনতে হলো এ বিষয়ে লিখিত আকারে জানতে চাওয়া হয় বিকাশ কর্তৃপক্ষের কাছে। এসব প্রশ্নের কোনো তথ্যভিত্তিক উত্তর দেয়া হয়নি। পরে আরও পাঁচটি প্রশ্ন পাঠানো হয়।
এর মধ্যে চতুর্থ প্রশ্ন ছিলÑ২০১৯ সালের আর্থিক প্রবিবেদনের নোট-৮ এ আদার দ্যান রিলেটেড পার্টিজ খাতে পাওনা (যা বিকাশ পাবে) দেখানো হয়েছে ১০২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে যা ছিল ৭০ কোটি ২৯ লাখ টাকা। ২০১৯ সালে এ খাতে পাওনার পরিমাণ এতটা বৃদ্ধির কারণ কী ও কাদের এ অর্থ দেয়া হয়েছে? আর কী বাবদ এবং কোন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের থেকে এ অর্থ পাওনা রয়েছে?
এর উত্তরে বিকাশ কর্তৃপক্ষ জানায়, ‘রিসিভেবল ফ্রম আদার দ্যান রিলেটেড পার্টিজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলো বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ব্যাংক-ব্যালেন্স ও এফডিআরের ইন্টারেস্ট রিসিভেবল। ২০১৮ সালের তুলনায় হায়ার ইফেক্টিভ ইন্টারেস্ট রেট, গ্রাহক এবং অন্যান্য ডিপোজিট ও অপারেশনাল ব্যাংক ব্যালান্স বাড়ার কারণেই এই বৃদ্ধি হয়েছে।’
অন্যদিকে বিকাশের ২০১৯ সালের আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অস্বচ্ছ বলে মনে করেন কি না? অস্বচ্ছ আর্থিক প্রতিবেদন দিয়ে বিকাশ থেকে কোনো গোষ্ঠী কি অর্থ লোপাট করেছে? এমন প্রশ্নটির উত্তর এড়িয়ে গিয়েছে বিকাশ কর্তৃপক্ষ।