ঢাকা || ২৮ আগস্ট ২০২৫

দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ঝুঁকিতে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত

মূলধন ঘাটতি, খেলাপি ঋণ আর শাসন সংকটে অস্থির অর্থনীতি

দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ঝুঁকিতে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত

ব্যাংক ইনফো

প্রকাশিত: ০৯:২০, ২০ আগস্ট ২০২৫

বাংলাদেশের ব্যাংক খাত বহুদিন ধরেই দুর্বল মূলধন কাঠামো ও উচ্চ খেলাপি ঋণের বোঝা বয়ে আসছিল। তবে ২০২৪ সালের আগস্টে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর গোপনে চাপা রাখা বিপুল পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত ঋণ প্রকাশ্যে চলে আসায় সংকট একেবারে প্রকট হয়ে ওঠে। ফলাফল—দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এখন সবচেয়ে নড়বড়ে অবস্থানে বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থা।

মূলধন পর্যাপ্ততার ভয়াবহ পতন

বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিনান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট বলছে, ২০২৪ সালের শেষে দেশের ব্যাংক খাতের মূলধন পর্যাপ্ততার হার (সিআরএআর) নেমে এসেছে মাত্র ৩.০৮ শতাংশে। অথচ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বেজেল–III অনুসারে এ হার ন্যূনতম ১২.৫ শতাংশ হওয়া আবশ্যক।

প্রতিবেশী দেশগুলো এ ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে। ভারতের হার ১৬.৭ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ১৮.৪ শতাংশ আর পাকিস্তানে ২০.৬ শতাংশ। ছোট অর্থনীতির দেশ নেপাল, ভুটান, আফগানিস্তানও ১০ শতাংশের ওপরে আছে। তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান যেন এক সতর্ক সংকেত।

গলদ কোথায়?

বিশেষজ্ঞদের মতে, সংকট নতুন নয়; এর শেকড় অনেক পুরোনো।

  • প্রথম প্রজন্মের ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় প্রাথমিক মূলধন ছিল মাত্র ৩ কোটি টাকা—যা অস্বাভাবিকভাবে কম।

  • ঋণ চাহিদা ও আমানত দ্রুত বেড়েছে, কিন্তু নতুন শেয়ার ইস্যু বা যথাযথ মূলধন সংযোজন হয়নি।

  • শাসন সংকট, রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা খেলাপি ঋণকে ভয়াবহ পর্যায়ে নিয়ে গেছে।

  • জামানতের অবমূল্যায়ন ও বড় ঋণগ্রহীতাদের দায়মুক্ত সংস্কৃতি ব্যাংকের স্থিতিশীলতা নষ্ট করেছে।

অভিজ্ঞ ব্যাংকার আনিস এ খান স্পষ্ট করেই বলেছেন—“মূলধনভিত্তি এত দুর্বল যে ব্যাংকগুলো কার্যকরভাবে ঋণ দিতে পারছে না। জমা কার্যত ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে।”

সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে কারা?

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী—

  • রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও শরিয়াভিত্তিক বেসরকারি ব্যাংকগুলো সবচেয়ে নাজুক অবস্থায়।

  • সাতটি ইসলামী ব্যাংকের সম্মিলিত সিআরএআর ২০২৩ সালের ১২.৭১ শতাংশ থেকে ২০২৪ সালে নেমে ঋণাত্মক –৪.৯৫ শতাংশে গেছে।

  • বিপরীতে বিদেশি ব্যাংকগুলো তুলনামূলক ভালো অবস্থানে আছে।

সম্ভাব্য ঝুঁকি

স্ট্রেস টেস্ট বলছে, দেশের মাত্র দুই বৃহৎ ঋণগ্রহীতা যদি খেলাপি হয়ে যায়, পুরো ব্যাংক ব্যবস্থা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।

করণীয় কী?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আস্থা ফিরিয়ে আনতে এখন জরুরি কিছু সংস্কার দরকার—পুনঃমূলধনীকরণ: নতুন শেয়ার ইস্যু ও বিনিয়োগ বাড়িয়ে মূলধন ঘাটতি পূরণ।  বড় ঋণগ্রহীতার দায়বদ্ধতা: রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে তাদের থেকে খেলাপি আদায় নিশ্চিত করা। বোর্ড সংস্কার: দক্ষ পেশাজীবী পরিচালক অন্তর্ভুক্ত করে শাসনব্যবস্থা শক্তিশালী করা। স্বচ্ছতা: ক্ষতিগ্রস্ত ঋণের তথ্য গোপন না রেখে নিয়মিত প্রকাশ করা। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা: প্রতিবেশী দেশগুলোর সফল সংস্কার মডেল থেকে শিক্ষা নেওয়া।

বাংলাদেশের ব্যাংক খাত শুধু একটি খাত নয়, গোটা অর্থনীতির ভিত্তি। এই ভিত্তি দুর্বল হলে বিনিয়োগ, শিল্পোন্নয়ন থেকে শুরু করে সাধারণ আমানতকারীর সঞ্চয়—সবই ঝুঁকির মুখে পড়ে। তাই সংস্কার ও আস্থা ফেরানো এখন সময়ের দাবি। দেরি হলে এর খেসারত দিতে হতে পারে পুরো অর্থনীতিকে।