ঢাকা || ০৫ নভেম্বর ২০২৫

পাচার হওয়াসম্পদ উদ্ধারে অনিশ্চয়তা, আশার আলো ম্লান

পাচার হওয়াসম্পদ উদ্ধারে অনিশ্চয়তা, আশার আলো ম্লান

ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস

প্রকাশিত: ০১:০৫, ৫ নভেম্বর ২০২৫

উত্তর-অভ্যুত্থানকালীন অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষিত বহুল আলোচিত চুরি হওয়া সম্পদ উদ্ধারের অভিযান শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হতে পারে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার অভ্যন্তরীণ সূত্র জানাচ্ছে, বিভিন্ন আইনি জটিলতা ও প্রশাসনিক দ্বন্দ্বের কারণে এ উদ্যোগে তেমন অগ্রগতি হয়নি।

এমনকি কর ফাঁকির অর্থ উদ্ধারের প্রক্রিয়াও স্থবির হয়ে আছে, কারণ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত কর্তৃক স্থগিত ব্যাংক হিসাব থেকে কর আদায়ে আইনগত বাধা রয়েছে।

প্রাতিষ্ঠানিক দ্বন্দ্ব বড় বাধা:

সম্পদ ও কর উদ্ধারে আন্তঃসংস্থার সমন্বয়হীনতা বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা দিয়েছে। রাজস্ব কর্তৃপক্ষের মতে, ব্যাংক হিসাব থেকে ফাঁকি দেওয়া কর আদায় সহজ হলেও আইনি জটিলতা এর পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাজস্ব বোর্ডের অধীন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) আদালতে আবেদন করে সন্দেহভাজনদের ব্যাংক হিসাব ‘ডিফ্রিজ’ করার অনুমতি পেলেও পরবর্তীতে অন্যান্য পক্ষ আপত্তি জানালে আদালত পুনরায় ‘স্টে অর্ডার’ জারি করে।

রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা ও সীমাবদ্ধতা:

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মন্সুর, যিনি সম্পদ উদ্ধারের কার্যক্রমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, জানান যে আদালতের বাইরে সমঝোতায় না যাওয়ায় সরকারের পক্ষে সম্পদ উদ্ধার এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।

তিনি বলেন, “এসব মামলা অত্যন্ত রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল। রাজনৈতিক দলগুলো আদালতের বাইরে সমঝোতাকে অভিযুক্তদের রাষ্ট্রীয় অর্থ প্রদানের সমতুল্য মনে করে।”

তবে এই উদ্যোগের ফলে বিদেশে অবস্থিত বিনিয়োগকারীদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে—বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) কর্তৃক সম্পদ ‘ফ্রিজ’ করার ঘটনাকে তিনি উল্লেখ করেন।

শুধু এক মামলায় সামান্য আশা:

গভর্নর বলেন, “বাস্তবতা হলো, আমরা হয়তো কখনোই চুরি হওয়া সম্পদ ফেরত পাব না। শুধুমাত্র সাইফুজ্জামান-এর মামলায় সামান্য আশা আছে।”

তিনি আরও জানান, ব্যাংক আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়াই এখন প্রধান অগ্রাধিকার, কর আদায় নয়।

বিদেশি সহযোগিতায় ধীরগতি:

বাংলাদেশ পাঁচটি দেশে প্রেরিত এক ডজন মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স (এমএলএ) চিঠির জবাব এখনো পায়নি। কিছু দেশ আবার অতিরিক্ত তথ্য চেয়েছে।

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) এক কর্মকর্তা জানান, “আমরা আগে এমন এমএলএ খসড়া তৈরির অভিজ্ঞতা পাইনি, এখন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।”

যৌথ তদন্ত টাস্কফোর্সের ধীর অগ্রগতি:

গত বছর গঠিত যৌথ তদন্ত টাস্কফোর্স (জেআইটি)–এর আওতায় রয়েছে দুদক, সিআইসি, বিএফআইইউ, সিআইডি এবং কাস্টমস গোয়েন্দা অধিদপ্তর। ১১ জন শীর্ষ ব্যবসায়ীকে লক্ষ্য করে গঠিত এই টাস্কফোর্সের কার্যক্রমের কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে তাদের বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারের জন্য আইনজীবী প্রতিষ্ঠান নিয়োগে ‘নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট’ সই করার নির্দেশনা দিয়েছে।

তবে গভর্নর ড. মন্সুর বলেন, “সরকার নিজে এ সংক্রান্ত মামলা করতে পারে না, ব্যাংকগুলোকেই তা করতে হবে।”

ব্যাংক নির্বাহীদের হতাশা:

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “চুরি হওয়া সম্পদ উদ্ধার এখন ‘আশার ওপরে আশা’ মাত্র। কোনো সফল উদাহরণ নেই, তাই এককভাবে কোনো ব্যাংকের পক্ষে এ চ্যালেঞ্জ নেওয়া কঠিন।”

তবে তিনি মনে করেন, যদি পুনরুদ্ধারে সফল হলে আইনজীবী প্রতিষ্ঠানকে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা রাখা হয়, তবে তা যৌক্তিক হতে পারে।

মানবিক বিবেচনায় অর্থ ফেরতের আবেদন:

বাংলাদেশ ব্যাংক যুক্তরাজ্য সরকারের কাছে মানবিক বিবেচনায় চুরি হওয়া অর্থ ফেরতের আবেদন করার কথা বিবেচনা করছে।

এর আগে যুক্তরাজ্যের অনুরোধে বাংলাদেশ দুইবার বয়স্ক হাজীদের তহবিল ফেরত দিয়েছিল।

সাইফুজ্জামান মামলায় যুক্তরাজ্য ইতিমধ্যে প্রশাসক নিয়োগ করেছে, যারা ঋণ পরিশোধ শেষে অবশিষ্ট অর্থ ফেরত দিতে পারে।

ড. মনসুর বলেন, “এ প্রক্রিয়া শেষ হলে আমাদের চুরি হওয়া অর্থের একটি অংশ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, তবে যুক্তরাজ্য সরকার নিজস্ব তহবিল নিয়ে আপস করবে না।”

অগ্রগতিহীন আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ:

এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশ বিদেশি কোনো আদালতে চুরি হওয়া অর্থ উদ্ধারের আবেদন জমা দেয়নি। কোনো দ্বিপাক্ষিক চুক্তিও সম্পন্ন হয়নি।

জেআইটি–এর কার্যক্রমে নির্দিষ্ট সময়সূচি না থাকায় এবং দুদকের প্রায় অর্ধেক কর্মকর্তা এতে যুক্ত থাকায় দুর্নীতি দমন কমিশন নিজস্ব তদন্তেও জনবল সংকটে পড়েছে।

একজন বিএফআইইউ কর্মকর্তা বলেন, “আমরা কেন্দ্রীয়ভাবে সহায়তা দিতে পারি, তবে ব্যাংকগুলোকে নিজেদের সম্পদ নিজেরাই উদ্ধার করতে হবে।”

তার ভাষায়, “বর্তমান সরকারের মেয়াদে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত পাওয়ার আশা ক্ষীণ।”