ঢাকা || ২৮ আগস্ট ২০২৫

অর্থ উপদেষ্টাকে গভর্নরের চিঠি

নগদের প্রাথমিক অনুমোদন বাতিল করে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অধীনে পুনর্গঠনের সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক

নগদের প্রাথমিক অনুমোদন বাতিল করে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অধীনে পুনর্গঠনের সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক

নগদের লোগো

ব্যাংক ইনফো

প্রকাশিত: ০১:৪৪, ২২ জুন ২০২৫

কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান নগদ-এর অন্তর্বর্তীকালীন অনুমোদন বাতিল করে রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাংকের সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুনর্গঠনের সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে নগদে অর্থ আত্মসাৎ, শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা ও অনিয়মের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণের ওপরও গুরুত্বারোপ করেছেন।

তিনি বলেন, “নগদের অন্তর্বর্তীকালীন অনুমোদন এখনই বাতিল করা উচিত।”

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে অস্থায়ী ব্যবস্থাপনা:
যদি সরকার নগদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে চায়, তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ নগদকে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অধীনে সাবসিডিয়িারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুনর্গঠন করতে পারে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করেন গভর্নর।

এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও নির্বাচিত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক যৌথভাবে নগদের পরিচালনা অস্থায়ীভাবে করতে পারবে। পরবর্তী ধাপে এটি কৌশলগত বিনিয়োগকারীর কাছে হস্তান্তরের মাধ্যমে বড় আকারের পুঁজি বিনিয়োগ ও টেকসই পরিচালনার সুযোগ তৈরি হবে।

ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তাইয়েব এক অফিসিয়াল চিঠিতে নগদে একজন সিইও নিয়োগ এবং সম্পূর্ণ নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠনের সুপারিশ করেছেন।

গত ১৮ মে অর্থ উপদেষ্টা, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অ্যাটর্নি জেনারেলসহ উচ্চ পর্যায়ের এক সভায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালক মোতাছিম বিল্লাহকে নগদের সিইও হিসেবে নিয়োগের বিষয়টি আলোচিত হয়।

এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে একটি সার-সংক্ষেপ প্রস্তুত করে অর্থ উপদেষ্টার অনুমোদনের জন্য জমা দিতে বলা হয়েছে। এতে নগদকে যৌথ মুলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমুহের পরিদপ্তরে (আরজেএসসি) কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধন, তিন মাসের মধ্যে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের অধীনে নতুন কোম্পানি গঠন, নতুন পর্ষদ ও আইনি কাঠামো গঠন এবং সম্পদ ও দায় স্থানান্তরের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

দীর্ঘমেয়াদি অনুমোদন সংকট
নগদ ২০১৯ সালের মার্চে ডাক বিভাগের উদ্যোগে অনুমোদনহীনভাবে যাত্রা শুরু করে। ২০২০ সালের মার্চে রাজনৈতিক চাপে বিবি ছয় মাসের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন অনুমোদন দেয়, যা ইতোমধ্যে নয়বার বাড়ানো হয়েছে, সর্বশেষ ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কার্যকর।

অনিয়ম ও মামলা
২০২৪ সালের আগস্টে রাজনৈতিক অস্থিরতার পর নগদের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা দেশত্যাগ করেন। এরপর ২১ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক একটি প্রশাসনিক দল নিয়োগ করে।

পরবর্তীতে ১৮ নভেম্বর জমা দেওয়া এক তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে, নগদ ৬৪৫ কোটি টাকার অতিরিক্ত ই-মানি তৈরি করেছে, যার কোনো নগদ ভিত্তি ছিল না। এছাড়া, ১৭১১ কোটি টাকার সরকারি ভাতা ৪১টি অননুমোদিত ডিস্ট্রিবিউটরের মাধ্যমে উত্তোলন করা হয়।

এরপর ৩ ফেব্রুয়ারি মতিঝিল থানায় একটি অর্থ আত্মসাতের মামলা দায়ের করা হয়। নগদের এক পরিচালক উচ্চ আদালতে প্রশাসক নিয়োগ চ্যালেঞ্জ করলে হাইকোর্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত বহাল রাখে, তবে আপিল বিভাগ ৮ সপ্তাহের জন্য স্থগিতাদেশ দেয়, যা ১২ মে থেকে কার্যকর।

এর ফলে প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায় এবং অভিযোগ রয়েছে, নগদের সাবেক এমডি তানভির আহমেদ মিশুক – যিনি মামলার আসামি – ইমেইলের মাধ্যমে আরেক আসামি শাফায়েত আলমকে সিইও হিসেবে নিযুক্ত করেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের অভিযোগ, উভয় আসামি এখনো নগদের আর্থিক ও আইটি কার্যক্রম পরিচালনা করছেন, যেখানে অবৈধ টাকা স্থানান্তরসহ বিভিন্ন অনিয়ম চলমান।

আস্থা সংকট ও দুর্নীতি তদন্ত
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তর নগদের মাধ্যমে ভাতা বিতরণ থেকে বিরত থাকতে পারে। যেহেতু এই খাত নগদের মূল আয়ের উৎস, এতে তার টিকে থাকা অনিশ্চিত হয়ে উঠবে বলে মত দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

তাছাড়া, পোস্টাল ডিপার্টমেন্টের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা না থাকায়, তারা এমএফএস পরিচালনার যোগ্য নয় বলেও মন্তব্য করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

২০১৮ সালের এমএফএস নিয়ম অনুযায়ী, কেবল তালিকাভুক্ত ব্যাংকসমূহই এমএফএস পরিচালনা করতে পারে, যা নগদের বর্তমান কাঠামোকে বিধিবহির্ভূত করে তোলে।

অন্যদিকে, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তানভীর আহমেদ মিশুকসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে ৬৪৫ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলা করেছে।

এছাড়া, ৩০ মে দৈনিক মানবজমিনে "গোপন সূত্র" উদ্ধৃত করে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ডাক ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের ব্যক্তিগত সহকারী আতিক মুর্শেদ নগদ থেকে ১৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন এবং তাঁর আত্মীয়দের জন্য বিভিন্ন শীর্ষ পদ নিশ্চিত করেছেন।

মুর্শেদ এর আগে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রধান নাহিদ ইসলামের ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচালক জেনারেল (প্রিভেনশন) আখতার হোসেন ১ জুন সাংবাদিকদের জানান, নগদে দুর্নীতি ও অবৈধ নিয়োগের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। যদিও আতিক মুর্শেদ এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।