
নিজের ভাবির বিয়েতে ভালোবাসার উপহার হিসেবে এক জোড়া সোনার দুল কিনেছিলেন ঢাকার বেসরকারি চাকরিজীবী ফারজানা খালেদ। কিন্তু ৫০ হাজার টাকার সেই দুলের বিল মেটাতে গিয়ে আনন্দের চেয়ে যেন বেড়েছে হাহাকার।
“দুই বছর আগেও যেই ছোট লকেটওয়ালা চেইনটা কিনতাম ২৫ হাজার টাকায়, এখন তার দাম প্রায় দ্বিগুণ,” বললেন ফারজানা। “আমার বিয়েতে আত্মীয়রা ছোট ছোট সোনার গয়না দিয়েছিল। এখনকার সময়ে এমন উপহার বিলাসিতার পর্যায়ে চলে গেছে।”
বাংলাদেশে যেখানে সোনা শুধু অলংকার নয়, বরং সামাজিক মর্যাদা ও সম্পদের প্রতীক — সেখানে এক ভরি সোনার দাম এখন সর্বোচ্চ ২ লাখ ১৬ হাজার টাকা। মাত্র ২৬ মাস আগেও যা ছিল প্রায় অর্ধেক।
বাংলাদেশ জুয়েলার্স এসোসিয়েশন (বাজুস) জানিয়েছে, বাজারে এখন ক্রেতা কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণি—যারা একসময় সোনার বাজারের প্রধান ক্রেতা ছিলেন।
বরিশালের শাহাদাত জুয়েলার্সের মালিক শেখ মোহাম্মদ মুসা জানান, “আগে বিয়ে বা পূজায় মানুষ সোনার গয়না উপহার দিত। এখন দাম এত বেড়েছে যে সেই রীতি প্রায় হারিয়ে গেছে।”
খুলনার এক ব্যবসায়ী বলেন, সাম্প্রতিক দুর্গাপূজার সময় বহু বিয়ে হলেও খুব কম মানুষই নতুন সোনা কিনেছে। “যাদের ঘরে পুরোনো সোনা ছিল, তারা সেটা গলিয়ে ব্যবহার করেছে। কেউ কেউ আবার সামাজিক কারণে কেবল একটা ছোট আংটি বা পাতলা চেইন কিনেছে।”
বাজুসের সহসভাপতি মাসুদুর রহমান বলেন, “যারা আগে দুই-তিন হাজার টাকার সোনার গয়না কিনত, তারা এখন পুরোপুরি বাজার থেকে হারিয়ে গেছে।”
শ্রীমঙ্গলের ব্যাংকার সুকান্ত দাস, যার বিয়ে ২০২৬ সালে, এখন থেকেই খরচ কমিয়ে সোনা কেনার জন্য সঞ্চয় করছেন।স“আমাদের সমাজে সোনা ছাড়া বিয়ে অসম্পূর্ণ মনে করা হয়,” তিনি বলেন।
নতুন কেনা নয়, পুরোনো বিক্রি বা বিনিময় গৃহিণী কবিতা ঘোষ জানালেন, তাদের পরিবারে দুর্গাপূজায় ছোট সোনার গয়না উপহার দেওয়া ছিল এক ঐতিহ্য। কিন্তু এখন “এই রীতি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।”
বিশ্ববাজারে সোনার দাম আউন্সপ্রতি ৪,০০০ ডলার ছাড়িয়েছে, যা ইতিহাসের সর্বোচ্চ। শুধু এ বছরেই দাম বেড়েছে প্রায় ৫৪ শতাংশ। ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা, মুদ্রাস্ফীতি এবং ডলারের দুর্বলতা—সব মিলিয়ে এই উল্লম্ফন।
ফরাসি ব্যাংক সোসাইটি জেনারেল ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, দ্রুতই দাম ৫,০০০ ডলার প্রতি আউন্সে পৌঁছানো “অবশ্যম্ভাবী।”
বিশ্বজুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ২০২২ সাল থেকে প্রতি বছর ১,০০০ টনের বেশি সোনা কিনছে, যা দশকের রেকর্ড। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্যান্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে থাকা সোনার মোট মূল্য দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩.৯৩ ট্রিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে সোনা রয়েছে মাত্র ১৪.২৮ টন, যেখানে পাকিস্তানের ৬৪.৭৫ টন ও ভারতের ৮৭৯.৯৮ টন।
দেশে বছরে প্রায় ৪০ টন সোনার চাহিদা থাকলেও এর ৮০ শতাংশই আসে চোরাচালানের মাধ্যমে, যা সরকারের রাজস্ব ঘাটতি বাড়ায় এবং দামকে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে আরও বেশি করে তোলে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে অনুমোদিত ২১টি ডিলার মিলে আমদানি করেছে ১ টনেরও কম সোনা। ফলে ব্যাগেজ রুলসের আওতায় আনা সোনাই এখন প্রধান উৎস।
অন্যদিকে, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নও দাম বাড়ার অন্যতম কারণ।
বাজুসের হিসাব অনুযায়ী—জানুয়ারি ২০১৮: প্রথমবার এক ভরির দাম ৫০ হাজার টাকা, জুলাই ২০২৩: ১ লাখ টাকা
ফেব্রুয়ারি ২০২৫: ১.৫ লাখ টাকা, বর্তমানে: ২.১৬ লাখ টাকা।
তবুও বিক্রেতারা বলছেন, এই দামে মানুষ সোনা বিক্রি করতেও অনাগ্রহী। “মানুষ মনে করে আজ বিক্রি করলে ১০ লাখ পাবে, কিন্তু এক মাস পর হয়তো ১২ লাখ পাবে,” বলেন বাজুসের মাসুদুর রহমান।
বাজুসের মতে, বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে হলে সাপ্লাই চেইনকে আনুষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে। “বাংলাদেশ ব্যাংক যদি সরাসরি সোনা আমদানি করতে পারে, তাহলে দাম স্থিতিশীল হবে ও বাজার স্বচ্ছ হবে,” বলেন রহমান।
সোনায় নতুন আগ্রহ: অলংকার নয়, বিনিয়োগ: “অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময়ে সোনা সবসময়ই নিরাপদ বিনিয়োগ। এখন মানুষ শুধু গয়না হিসেবে নয়, সঞ্চয় হিসেবেও সোনা কিনছে।”
২০২৫ সালে এখন পর্যন্ত দেশে সোনার দাম বেড়েছে ৫৬ শতাংশ, আর সেই সঙ্গে বেড়েছে ছোট সোনার বার ও কয়েনের চাহিদা।
“সোনার সাংস্কৃতিক মূল্য এখন বিনিয়োগের কৌশল হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে। একসময় সোনার গয়না ছিল আনন্দ ও ঐতিহ্যের প্রতীক। এখন তা হয়ে উঠছে আর্থিক চাপের প্রতীক—ঢাকা থেকে বরিশাল পর্যন্ত অসংখ্য পরিবারের কাছে।