ঢাকা || ০৪ জুন ২০২৫

বাজার ভিত্তিক বিনিময় হারের ভয় কাটিয়ে উঠল বাংলাদেশ ব্যাংক

বাজার ভিত্তিক বিনিময় হারের ভয় কাটিয়ে উঠল বাংলাদেশ ব্যাংক

ব্যাংক ইনফো

প্রকাশিত: ১১:১৭, ১৬ মে ২০২৫

বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের অপেক্ষার পর ১.৩ বিলিয়ন ডলারের আইএমএফ ঋণের কিস্তি এখন আবার সঠিক পথে এসেছে। এর পেছনে বড় নীতিগত প্রতিবন্ধকতা দূর করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক: বাজারভিত্তিক বিনিময় হার ব্যবস্থার দিকে যাত্রা। দীর্ঘদিন স্থিতিশীলতার ভয়ে এই সংস্কার থেকে বিরত থাকলেও, এটি দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি শক্ত বার্তা।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল তার ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের কর্মসূচির চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি স্থগিত রেখেছিল দুটি কাঠামোগত শর্ত পূরণ না হওয়ায়: এক, কর প্রশাসন সংস্কার, এবং দুই, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারকে নমনীয় করা। মে মাসে সরকার উভয় ক্ষেত্রেই অগ্রগতি দেখিয়েছে—জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে দুটি আধুনিক শাখা গঠন করা হয়েছে, এবং ব্যাংকগুলোকে বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের ভিত্তিতে ডলার লেনদেন করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

যদিও আইএমএফ নির্বাহী বোর্ডের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন এখনও বাকি, আশা করা হচ্ছে জুন মাসেই ১.৩ বিলিয়ন ডলার ছাড় হবে। তবে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো বাজার ইতোমধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। দীর্ঘদিন কেন্দ্রীয় নির্দেশনা ও সংকীর্ণ ট্রেডিং ব্যান্ডের মধ্যে আবদ্ধ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এই নীতিগত পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছে, যা তাদের আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে আরও স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিচ্ছে।

এটি শুধুমাত্র আইএমএফ-এর অর্থ পাওয়ার বিষয় নয়। এই চুক্তি বাংলাদেশের বিশ্বাসযোগ্যতা পুনঃস্থাপনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই সংস্কারের মাধ্যমে শুধু বহুপাক্ষিক তহবিলই নয়, বরং একটি ব্যাপক আস্থা-প্রিমিয়াম উন্মোচিত হয়েছে। মুডিজের মতো রেটিং এজেন্সি এবং বিশ্ব ব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো উন্নয়ন সহযোগীরা এখন বাংলাদেশের সঙ্গে আরও গঠনমূলকভাবে কাজ করতে প্রস্তুত, যা বৈদেশিক অর্থায়নের চাপে স্বস্তি আনবে।

বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “স্থির নীতির সঙ্গে কম সংযুক্ত থেকে এবং অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে বেশি সংযুক্ত হয়ে এই পরিবর্তন আন্তর্জাতিক রীতিনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়েছে। এটি বাংলাদেশকে বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার সঙ্গে আরও ভালোভাবে যুক্ত হওয়ার পথ করে দিয়েছে।”

শ্রীলঙ্কা থেকে নেওয়া শিক্ষা
বাংলাদেশের সতর্ক পন্থা ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার হঠাৎ মুদ্রানীতির উদারিকরণের সঙ্গে একটি স্পষ্ট পার্থক্য তৈরি করে। রিজার্ভ ফুরিয়ে যাওয়া ও অর্থনীতি ধসে পড়ার মুখে, শ্রীলঙ্কা তাদের রুপি সম্পূর্ণ ভাসাতে দেয়, যার ফলে ডলারের বিপরীতে রুপির মান ২০০ থেকে নেমে ৩৬০-তে পৌঁছে যায়, পরে তা ২৯৯-এর আশেপাশে স্থিতিশীল হয়।

এই বেদনাদায়ক পদক্ষেপ ছিল বাজারের বিকৃতি দূর করার ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ পুনরুদ্ধারের জন্য অপরিহার্য। কর সংস্কার, ঋণ পুনর্গঠন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বতন্ত্রতার সঙ্গে মিলিয়ে এই পদক্ষেপ দেশটিকে দেউলিয়াত্ব থেকে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।

বাংলাদেশ ব্যাংক স্পষ্ট করেছে যে তারা এখনও “বাজারে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি প্রতিরোধে” হস্তক্ষেপ করবে। এটি একটি সংকর পদ্ধতি—বিনিময় হার আর কঠোরভাবে নির্ধারিত নয় বা কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রিত নয়, তবে একেবারেই বাজারচালিতও নয়। হস্তক্ষেপের বিকল্প রাখার মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত অস্থিরতা প্রশমিত করতে এবং আমদানি নির্ভর খাতকে হঠাৎ মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে রক্ষা করতে চায়।

তবুও, ভাসমান হার ব্যবস্থার পথে হাঁটায় কিছু ঝুঁকি রয়েছে। যথাযথ নজরদারি ছাড়া এই পরিবর্তন কৃত্রিম ডলার সংকট বা দাম কারসাজির মাধ্যমে জালিয়াতির নতুন সুযোগ তৈরি করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংককে এখন বাজার পর্যবেক্ষণ জোরদার করতে হবে এবং যেন কোনো অসাধু ব্যবসায়ী ব্যবস্থা অপব্যবহার করতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।

জাহিদ হোসেন বলেন, “প্রত্যেকটি বিনিময় হার ব্যবস্থায় নমনীয়তা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপের মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হয়। নমনীয়তা সরবরাহ ও চাহিদার ওঠানামার ভিত্তিতে বিনিময় হারকে প্রাকৃতিকভাবে সমন্বয় করতে সাহায্য করে, যা রিজার্ভের ওপর চাপ কমায়। তবে যদি এসব ওঠানামা অত্যধিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে, তবে রিজার্ভ থেকে হস্তক্ষেপের প্রয়োজন বাড়ে।”

এই সমস্যা মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক হঠাৎ বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি সামলাতে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের একটি স্থিতিশীলতা তহবিল ব্যবহার করার পরিকল্পনা করেছে। সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে, এই কৌশল নতুন ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখতে সাহায্য করতে পারে, আবার কঠোর নিয়ন্ত্রণে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়বে না।

নতুন ব্যবস্থার আসল পরীক্ষা হবে সংকটের মুহূর্তে—কেন্দ্রীয় ব্যাংক তখন বাজার সংকেতকে সম্মান করবে, না কি আগের মতো প্রশাসনিক হস্তক্ষেপে ফিরে যাবে, সেটাই দেখার বিষয়।

যা স্পষ্ট, তা হলো বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। বিনিময় হারে নমনীয়তা গ্রহণ করে এবং প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মাধ্যমে, দেশটি বিশ্বকে দেখিয়েছে—এবার সত্যিকারের পরিবর্তনের পথে যাত্রা শুরু হয়েছে।