
দেশের ব্যাংক খাতে জুন মাস শেষে আমানতের প্রবৃদ্ধি আট শতাংশের নিচেই রয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুন ২০২৫ শেষে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭.৭৭ শতাংশ বেশি।
তবে এই প্রবৃদ্ধি মে মাসের তুলনায় সামান্যই বেশি (৭.৭৩%)। গত বছরের জুনে আমানত প্রবৃদ্ধি ছিল ৯.২৫ শতাংশ। এরপর থেকে ক্রমাগত নিম্নমুখী প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গত ১৮ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি রেকর্ড হয়েছিল ২০২৪ সালের আগস্টে, মাত্র ৭.০২ শতাংশ।
মুদ্রাস্ফীতি ও কর্মসংস্থানের প্রভাব
ব্যাংকাররা বলছেন, সাধারণত মুদ্রাস্ফীতি কমলে আমানত বাড়ে। কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে কিছুটা কমলেও বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান স্থবির থাকায় মানুষের আয় বাড়ছে না। ফলে সঞ্চয় করার সক্ষমতা কমে গেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.৫৫ শতাংশে, টানা তিন মাসের নিম্নমুখী ধারা ভেঙে। খাদ্য ও অখাদ্য—দুই খাতেই একযোগে মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। বিশেষ করে চালের দাম দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ পর্যায়ে থাকায় নিম্নআয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। অনেকে এমনকি পূর্বে সঞ্চিত আমানত ভেঙে খরচ চালাচ্ছেন।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন,
“দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের এখন সঞ্চয় করার কোনো সামর্থ্য নেই। চালসহ নিত্যপণ্যের দাম এত বেশি যে আয় থেকে সঞ্চয়ের সুযোগ থাকে না। বরং টিকে থাকার জন্য তারা আগের আমানত ব্যবহার করছে।”
তিনি আরও বলেন, দুর্বল অর্থনৈতিক কার্যক্রম কর্মসংস্থান সৃষ্টি সীমিত করে ফেলেছে। ফলে আমানত বাড়ছে না। এছাড়া জুনের ঈদ উৎসবে অনেকে সঞ্চয় থেকে অর্থ তুলেছেন, যা প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলেছে।
আস্থার সংকট
ব্যাংকাররা মনে করেন, খেলাপি ঋণ ও দুর্বল ব্যাংক ব্যবস্থাপনার নানা খবর সাধারণ মানুষের আস্থা কমিয়ে দিয়েছে। অনেক আমানতকারী মনে করছেন, ব্যাংকে অর্থ রাখা ঝুঁকিপূর্ণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মансুর দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্তত ১৩টি ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন, তারল্য সহায়তা এবং গোপন ঋণ বন্ধের পদক্ষেপ নিয়েছেন। এগুলো পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল করলেও আমানতকারীদের আস্থা পুরোপুরি ফিরেনি।
বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী
জুন মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬.৪০ শতাংশে—যা সাম্প্রতিক বছরের মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন। চলতি বছর এর আগেও একাধিকবার ঋণ প্রবৃদ্ধি সাত শতাংশের নিচে নেমে গেছে।
ব্যাংকের বাইরে নগদের বৃদ্ধি
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুন শেষে ব্যাংকের বাইরে চলতি নগদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা, যা এক বছর আগের তুলনায় ২.০২ শতাংশ বেশি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ প্রবণতা অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। কারণ, নগদ অর্থ ব্যাংকে না এলে ঋণযোগ্য তহবিল সংকুচিত হয়, বিনিয়োগও কমে যায়। তাদের মতে, বাইরে থাকা নগদের বড় অংশই অপ্রকাশিত অর্থ, আর মুদ্রাস্ফীতিও এ প্রবণতাকে ত্বরান্বিত করছে।
২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থ ছিল ২ লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকা। তারপর থেকে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমাগত এ পরিমাণ বেড়েই চলেছে।