
বেক্সিমকোর পর এবার তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান নাসা গ্রুপকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি উদ্যোগ এসেছে। কয়েকটি কোম্পানি খেলাপি অবস্থায় থাকলেও শ্রমিকদের বেতন দেওয়া ও উৎপাদন সচল রাখতে সরকার ব্যাক-টু-ব্যাক এলসি খোলার সুবিধা এবং নীতিগত সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন ডিভিশনের অনুরোধে বাংলাদেশ ব্যাংক এ পদক্ষেপ নিয়েছে। এ বিষয়ে গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকে নাসা গ্রুপ ও অর্থায়নকারী সাতটি ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
শ্রমিক বেতনকে অগ্রাধিকার
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নাসা গ্রুপের জন্য খোলা ব্যাক-টু-ব্যাক এলসিগুলোর ১০০ শতাংশ মার্জিনে ঋণ খেলাপি ব্যাংকগুলো সরাসরি ঋণ আদায় করতে পারবে না। বরং প্রথমে ওই অর্থ শ্রমিকদের বেতন ও কারখানার দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে ব্যবহৃত হবে। উদ্বৃত্ত থাকলে তবেই ঋণ পরিশোধে যাবে।
শ্রম সচিব এ এইচ এম শফিকুজ্জামান বলেন, “প্রায় ২৫-২৭ হাজার শ্রমিক নাসা গ্রুপে কাজ করেন। প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে তারা বেকার হয়ে শ্রমিক আন্দোলনের ঝুঁকি তৈরি হবে। এ পরিস্থিতি এড়াতেই নীতিগত সহায়তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”
বকেয়া বেতন ও শ্রমিক অসন্তোষ
নাসা গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মোহাম্মদ সাইফুল আলম বলেন, “জুন পর্যন্ত বেতন পরিশোধ করা হলেও নতুন এলসি না খোলায় উৎপাদন স্থবির হয়ে পড়েছে। দ্রুত সমাধান না হলে শ্রমিকরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হবে।”
গত ১৪ আগস্ট বকেয়া বেতন পরিশোধ না হওয়ায় কিছু শ্রমিক বিক্ষোভও করেছেন। সূত্র জানায়, গ্রুপটির কারখানায় মাসিক মজুরি বাবদ ৪০–৪২ কোটি টাকা প্রয়োজন হয়।
নাসা গ্রুপের ঋণ ও খেলাপি অবস্থা
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, নাসা গ্রুপ ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো ২২টি ব্যাংক থেকে প্রায় ১০ হাজার ৩০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যার বড় অংশই এখন খেলাপি। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক থেকে ৩ হাজার কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ১ হাজার ৯৬১ কোটি, আইএফআইসি ব্যাংক থেকে ১ হাজার ১৫২ কোটি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি এবং শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ৪৫৮ কোটি টাকা রয়েছে।
শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের এমডি মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমাদের কাছে থাকা নাসা গ্রুপের অ্যাকাউন্টগুলো নিয়মিত। তবে অন্য ব্যাংকের খেলাপি হিসেবে সিআইবিতে তথ্য উঠায় জটিলতা তৈরি হয়েছে।”
চেয়ারম্যান নাজরুল ইসলাম মজুমদারের বিরুদ্ধে মামলা
গ্রুপটির চেয়ারম্যান ও সাবেক বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)-এর দীর্ঘদিনের সভাপতি নাজরুল ইসলাম মজুমদার বর্তমানে কারাগারে। গত বছর ১ অক্টোবর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
অর্থপাচার ও দুর্নীতির অভিযোগে সিআইডি তার বিরুদ্ধে ৭৮১ কোটি টাকার মামলার চার্জ গঠন করেছে। তদন্তে দেখা গেছে, ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে তিনি আমদানি–রপ্তানি জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে বিপুল অর্থ পাচার করেছেন।
সরকারের অবস্থান
শ্রম উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়—কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হতে দেওয়া যাবে না, কারণ এতে দেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে।
এদিকে বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেছেন, “নাসা গ্রুপ পুরোপুরি রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান। এর পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে ভালো গ্রহণযোগ্যতা আছে। ব্যবস্থাপনা সক্রিয় থাকলে বিজিএমইএ সর্বাত্মক সহায়তা দেবে।”
প্রেক্ষাপট
১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত নাসা গ্রুপের বর্তমানে ৩৪টি কারখানা রয়েছে। মূলত তৈরি পোশাক রপ্তানি হলেও তাদের কার্যক্রম বিস্তৃত টেক্সটাইল, স্পিনিং, লজিস্টিকস, রিয়েল এস্টেট ও ব্যাংকিং খাতে। চেয়ারম্যানের গ্রেপ্তারের পর থেকে উৎপাদন অনেক কমে গেছে, ব্যাংকগুলো নতুন এলসি বন্ধ করে দিয়েছে এবং অনেক বিদেশি ক্রেতা নতুন অর্ডার স্থগিত করেছে।
সরকারের সর্বশেষ এ হস্তক্ষেপে আশা করা হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন সচল থাকবে, শ্রমিকরা বেতন পাবেন এবং রপ্তানি আয় রক্ষা পাবে।