ঢাকা || ১২ জুন ২০২৫

রেকর্ড দামে পৌঁছেও কমছে না সোনার চাহিদা বাংলাদেশে

রেকর্ড দামে পৌঁছেও কমছে না সোনার চাহিদা বাংলাদেশে

ব্যাংক ইনফো

প্রকাশিত: ২২:১১, ৫ জুন ২০২৫

বিশ্বজুড়ে সোনার দাম যখন ইতিহাসের সর্বোচ্চ শিখরে, তখন বাংলাদেশে সোনার প্রতি মানুষের আগ্রহ যেন আরও জোরালো হয়েছে। বিয়ে, উৎসব বা পারিবারিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে নয়, বরং মূল্যস্ফীতি ও অনিশ্চিত অর্থনীতির বিপরীতে ‘নিরাপদ বিনিয়োগ’ হিসেবে সোনার প্রতি সাধারণ মানুষের নির্ভরতা বাড়ছে।

বিশ্বজুড়ে সোনার জোয়ার

ভয়াবহ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, মার্কিন ডলারের মূল্য ওঠানামা, শেয়ারবাজারের অস্থিরতা ও বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে সোনা সংযোজনের প্রবণতা—সব মিলিয়ে সোনার প্রতি বিনিয়োগকারীদের ঝোঁক আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ফলে বিশ্ববাজারে সোনার দাম প্রতিনিয়ত ঊর্ধ্বমুখী।

বাংলাদেশে সোনার মূল্য ও চোরাচালান

বাংলাদেশেও এই প্রবণতা লক্ষণীয়। ২০২৫ সালের ২৩ এপ্রিল বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস) ২২ ক্যারেট সোনার দাম প্রতি ভরিতে ৭৭৮৮৭ টাকা নির্ধারণ করে, যা ২০ এপ্রিলের তুলনায় ১০ হাজার বেশি। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে সমপরিমাণ সোনার মূল্য ১লাখ ৩৯ হাজার ৭২৫টাকার মতো, অর্থাৎ স্থানীয় বাজারে দাম অনেকটাই বেশি।

বাজুস জানায়, এই বাড়তি দামের পেছনে রয়েছে ৫% মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), ৬% শ্রম খরচসহ নানা অতিরিক্ত খরচ। তবে সমালোচকরা বলছেন, সোনার মূল্য নির্ধারণে স্বচ্ছতা নেই, যা বাজারে অস্থিতিশীলতা বাড়ায়।

এদিকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে কোনো সোনা আমদানি হয়নি বলেও জানা গেছে। অথচ দেশে বার্ষিক সোনার চাহিদা ২০-৪০ টনের মধ্যে। কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালে ‘ব্যাগেজ রুলস’-এর আওতায় ৩১ টনের বেশি সোনা দেশে ঢুকেছে। প্রায় ১০০ কোটি টাকার চোরাচালানি সোনা জব্দও করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এক হিসাবে, দেশের বার্ষিক সোনা চাহিদার ৮০%–এর জোগান আসে চোরাচালানের মাধ্যমে, বাকিটুকু রিসাইকেল করা পুরনো সোনা থেকে।

দাম বাড়লেও কেন সোনা কিনছেন মানুষ?

সাংস্কৃতিক অনিবার্যতা

সোনা বাংলাদেশের সংস্কৃতির গভীরে প্রোথিত। বিয়ে, ঈদ, পূজা কিংবা অন্যান্য পারিবারিক উৎসবে সোনার অলংকার কেনা রীতি। বংশপরম্পরায় সোনার গয়না উত্তরাধিকারসূত্রে হস্তান্তরও হয়। এই কারণে দামে যতই ঊর্ধ্বগতি থাকুক না কেন, কিছু পরিমাণ সোনা কেনা ‘অবশ্যক’ হয়ে দাঁড়ায়।

বানাস্রী এলাকার বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম বলেন, “অনেক দিন ধরে সঞ্চয় করেছি ৬-৭ ভরি সোনা কেনার জন্য। কিন্তু দামে এমন উল্লম্ফন হয়েছে যে পুরোটা কিনতে পারছি না। তারপরও কিছু না কিছু তো কিনতেই হবে, এটা তো আমাদের বিয়ের রীতির অংশ।”

অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও বিনিয়োগের আকর্ষণ

২০২৪ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ছিল ১১.৩৮%। আর সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানতের সুদহার ১১.৫২%-১১.৭৬%। ফলে প্রকৃত মুনাফা কার্যত শূন্য। এই প্রেক্ষাপটে সোনা তুলনামূলক নিরাপদ ও লাভজনক বিনিয়োগ হিসেবে উঠে এসেছে।

২০২২ সালের জুনে প্রতি ভরি সোনার দাম ছিল ৭৭২১৫ টাকা, যা ২০২৪ সালের মধ্যে বেড়ে ১ লাখ ৩৮ হাজার ২৮৮ হয়েছে। অক্টোবর ২০২৩-এ দাম ছিল ১ লাখ ৪৩ হাজার। অনেক সময় ২-৩ সপ্তাহেই প্রতি ভরিতে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ হয়, যা সোনাকে মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

পুঁজিবাজারে আস্থাহীনতা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সাইমা হক বিদিশা বলেন, “পুঁজিবাজারে সাধারণ মানুষের আস্থা কম। তার চেয়ে সোনা অনেক বেশি নিরাপদ মনে হয়। অনেকে ভাবেন, সোনার দাম ওঠানামা করলেও ক্ষতি বেশি হয় না। ফলে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্যও এটি ঝুঁকিমুক্ত মনে হয়।”

চোরাচালান ও নীতিগত দুর্বলতা

চোরাচালান সোনার বাজারে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। সোনার ওপর উচ্চ আমদানি করের কারণে বৈধ পথে সোনা আনা নিরুৎসাহিত হয়। এর ফলে ৭৩ হাজার কোটি টাকার চোরাচালানি বাজার গড়ে উঠেছে, যা স্থানীয় বাজারে অস্বচ্ছতা ও উচ্চমূল্যের অন্যতম কারণ।

অধ্যাপক বিদিশা বলেন, “বৈধ পথে নির্দিষ্ট মূল্যে সোনা আমদানির সুযোগ দিলে সরকার লাভবান হতে পারে। কিন্তু এর জন্য শর্ত ও প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে, যাতে বেশি মানুষ বৈধ পথে আসতে উৎসাহ পায়।”

উপসংহার

সোনা এখন আর শুধু অলংকার নয়, হয়ে উঠেছে একটি কৌশলগত আর্থিক সম্পদ। একদিকে সাংস্কৃতিক গুরুত্ব, অন্যদিকে বিনিয়োগ নিরাপত্তা—এই দুইয়ের সমন্বয়ে সোনার চাহিদা এখনও অটুট বাংলাদেশে, মূল্যবৃদ্ধি বা বাজার অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও।

তবে বাজারকে স্থিতিশীল ও স্বচ্ছ করতে হলে সরকারের উচিত নীতিগত সংস্কার, চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ এবং বৈধ আমদানি প্রক্রিয়া সহজ করা। না হলে এই উর্ধ্বগতির মধ্যে সাধারণ মানুষের সোনা কেনা হয়তো ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠবে।

city-bank
city-bank