
চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশের তালিকাভুক্ত ১০টি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) সম্মিলিতভাবে ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকার লোকসান গুনেছে। গত বছরের একই সময়ে এ খাতের লোকসান ছিল ৯২১ কোটি টাকা। অর্থাৎ, এক বছরে লোকসানের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ।
অন্যদিকে, একই সময়ে মাত্র ৬টি প্রতিষ্ঠান মুনাফা করতে সক্ষম হয়েছে, যার অঙ্ক ১৭৮ কোটি টাকা। এ পার্থক্য স্পষ্টভাবে তুলে ধরছে কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত ও দুর্বল প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় ভেঙে পড়া খাতটির সংকট।
বাংলাদেশে বর্তমানে ৩৫টি এনবিএফআই রয়েছে, এর মধ্যে ২৩টি তালিকাভুক্ত। এর মধ্যে ১৬টি প্রতিষ্ঠান অর্ধবার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সাতটি এখনো তথ্য দেয়নি এবং দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক দুরবস্থার কারণে আরও পাঁচটি প্রতিষ্ঠান নিয়মিতভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে পারছে না।
সর্বাধিক লোকসানি প্রতিষ্ঠান
প্রতিষ্ঠানভিত্তিক হিসাবে, ফিনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেড সর্বাধিক ৪৬৮ কোটি টাকার লোকসান করেছে। এরপর পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের লোকসান ১৮৯ কোটি টাকা এবং এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের লোকসান দাঁড়িয়েছে ১৪৭ কোটি টাকায়।
এ ছাড়া লোকসান করেছে ফার্স্ট ফাইন্যান্স লিমিটেড, মিডাস ফাইন্যান্সিং পিএলসি, ইসলামিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল লিমিটেড, বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও ফেয়ারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড।
অন্যদিকে, লাভজনক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আইডিএলসি ফাইন্যান্স সর্বোচ্চ ১১১ কোটি টাকা মুনাফা করেছে এবং ডিবিএইচ ফাইন্যান্স ৪২ কোটি টাকার মুনাফা করেছে।
সংকটের মূল কারণ
বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান কান্তি কুমার সাহা মনে করেন, দীর্ঘদিনের দুর্বল শাসনব্যবস্থা এবং আর্থিক অনিয়মই এ খাতকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছে।
তিনি বলেন, “যদি প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, ক্লায়েন্ট বাছাই এবং শ্রেণিকরণ নির্দেশিকা অনুসরণ করত, তবে আজকের পরিস্থিতি হতো না।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা ও চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ২০টি অচলাবস্থায় থাকা এনবিএফআইকে তরল অর্থ সহায়তা দিয়েছে, যা পুনর্গঠন ও সম্ভাব্য একীভূতকরণের লক্ষ্যে ব্যবহার হবে। তবে, নিয়ন্ত্রকের মূল নজর এখনো ব্যাংক খাতে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র মোহাম্মদ শহরিয়ার সিদ্দিকী বলেন, “মোট আর্থিক খাতের তুলনায় এনবিএফআই খাতের আকার মাত্র ৫ থেকে ৬ শতাংশ। তাই আপাতত ব্যাংক খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।”
কাঠামোগত দুর্বলতা
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক শহর মোহাম্মদ আহসান হাবিব বলেন, এনবিএফআই খাত বর্তমানে এক ঝড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। তার মতে, দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদানের জন্য এনবিএফআইগুলোকে দীর্ঘমেয়াদি বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে অর্থায়ন করতে হবে। কিন্তু বর্তমানে তারা স্বল্পমেয়াদি আমানতের ওপর নির্ভর করছে, যা ‘অ্যাসেট-লাইয়াবিলিটি মিসম্যাচ’-এর ঝুঁকি তৈরি করছে।
তিনি মনে করেন, কেবল একটি শক্তিশালী পুঁজিবাজারই বন্ড ইস্যুকারীদের টিকিয়ে রাখতে পারে এবং খাতটির সুস্থতা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হতে পারে।
এখনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি যেসব প্রতিষ্ঠান
যেসব এনবিএফআই এখনো তাদের অর্ধবার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি, তাদের মধ্যে রয়েছে—উত্তরা ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেড, প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স লিমিটেড, লঙ্কাবাংলা ফাইন্যান্স পিএলসি, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড এবং জিএসপি ফাইন্যান্স কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড।