
উৎপাদন কার্যক্রম সচল রাখা ও বিপর্যস্ত নাসা গ্রুপে কর্মসংস্থান রক্ষা করার ঘোষিত উদ্দেশ্যে, প্রায় ৪০ বিলিয়ন টাকা (৪ হাজার কোটি টাকা) মূল্যের খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ পোশাক প্রস্তুতকারক এই প্রতিষ্ঠানটির ঋণ নেওয়া হয়েছে পাঁচটি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে—অভ্যন্তরীণ সূত্রে বুধবার এ তথ্য জানা গেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ সহায়তা প্যাকেজটি প্রস্তুত করছে।
নাসা গ্রুপের মালিক নজরুল ইসলাম মজুমদার, যিনি বর্তমানে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের আমলে সংঘটিত নানা অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে কারাগারে রয়েছেন, তার প্রতিষ্ঠানকে ঘিরেই এই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, “নাসা গ্রুপ কর্মসংস্থান ও রপ্তানি আয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বিধায়, আইনানুগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের কিছু ঋণ পুনঃতফসিলের অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।”
তিনি জানান, পোশাক শিল্পের এই বড় প্রতিষ্ঠানকে ১ শতাংশ ডাউন পেমেন্টের বিনিময়ে ৪০ বিলিয়ন টাকার ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ দেওয়া হবে। এই সুবিধায় এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ৮ বছরের মেয়াদে পরিশোধের সুযোগ থাকবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গঠিত ঋণ-পুনঃতফসিল কমিটি ইতোমধ্যে এই সুবিধা অনুমোদন করেছে, যাতে নাসা গ্রুপের উৎপাদন, রপ্তানি ও কর্মসংস্থান কার্যক্রম অব্যাহত থাকে, বলেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এর এক কর্মকর্তা।
তিনি আরও জানান, “বিশেষ বিবেচনায় নাসা গ্রুপের এই কেসটি গ্রহণ করা হয়েছে, কারণ দেশজুড়ে তাদের প্রায় ২৫টি কারখানায় প্রায় ২২ হাজার শ্রমিক ও কর্মচারী কর্মরত।”
অবৈধ সম্পদ ও অর্থপাচারের অভিযোগে মালিক কারাগারে:
এরই মধ্যে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট গত ২৫ আগস্ট নজরুল ইসলাম মজুমদার ও তার স্ত্রীর সব ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দেয়।
২০২৪ সালের ২ অক্টোবর, গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৭৮১ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে।
গ্রেপ্তারের পর অপরাধ তদন্ত বিভাগ তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে, অভিযোগ করা হয় তিনি রপ্তানির আড়ালে প্রায় ৩০ লাখ মার্কিন ডলার (প্রায় ৩৫ কোটি টাকা) যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করেছেন।
সিআইডি-র এক বিবৃতিতে বলা হয়, নজরুল এই ট্রেড-বেইজড মানি লন্ডারিং করেছেন ফিরোজা গার্মেন্টস নামে নাসা গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।
বাংলাদেশ ব্যাংকও অর্থপাচার ও ঋণ খেলাপির অভিযোগে নাসা গ্রুপের এলসি খোলা ও আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং কার্যক্রম স্থগিত করেছে, যার মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির মালিকানাধীন এক্সিম ব্যাংকও রয়েছে।
কারখানা বন্ধ, মজুরি বকেয়া, সরকারী প্রশাসকের নিয়োগ
নাসা গ্রুপ, যেখানে ২২ হাজারের বেশি শ্রমিক কর্মরত, জুলাই থেকে কারখানা বন্ধ থাকার কারণে শ্রমিকদের মজুরি দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির ওপর বর্তমানে ২২টি ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে মোট ৮৬.৭৬ বিলিয়ন টাকার (৮,৬৭৬ কোটি) দেনা রয়েছে।
এর ফলে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে শ্রমিক বিক্ষোভ চলতে থাকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার একজন প্রশাসক নিয়োগ দেয় এবং জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত শ্রমিকদের বেতন ধীরে ধীরে পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেয়, যা নাসা গ্রুপ ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের মধ্যে এক চুক্তির মাধ্যমে কার্যকর হচ্ছে।
অতিরিক্ত মামলা ও তদন্ত:
নাসা চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার, যিনি একই সঙ্গে এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান, গত ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি আদালতের আদেশে গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থান-সংক্রান্ত একটি হত্যা প্রচেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে নাসা গ্রুপের পুরো ব্যবসা ও পরিচালনা তদারকি করার জন্য ৯ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেছে।
এদিকে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নাসা চেয়ারম্যান নজরুল মজুমদারের সম্পদ বিক্রি করে শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি ও প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ পরিশোধ করা হবে।