ঢাকা || ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫

৭০০ মেগাহার্টজ স্পেকট্রাম নিলামে প্রতি মেগাহার্টজ-এ আয় হবে ২৩৭ কোটি টাকা

১৮ বছরের জটিলতার অবসানে এগোচ্ছে

৭০০ মেগাহার্টজ স্পেকট্রাম নিলামে প্রতি মেগাহার্টজ-এ আয় হবে ২৩৭ কোটি টাকা

ব্যাংক ইনফো

প্রকাশিত: ০০:১৭, ২৬ নভেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশ সরকার বহুল প্রতীক্ষিত ৭০০ মেগাহার্টজ স্পেকট্রাম নিলামের আর্থিক শর্ত অনুমোদন করেছে। উচ্চমূল্যের এ ব্যান্ড বিক্রি করে সরকার প্রতি মেগাহার্টজ থেকে আয় করতে পারে ২৩৭ কোটি টাকা—যা দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে নতুন যুগের সূচনা করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

২২ নভেম্বর অর্থ বিভাগের অনুমোদিত নথি অনুযায়ী, টেলিযোগাযোগ বিভাগের প্রস্তাব অনুযায়ী ১৫ বছরের জন্য প্রতি মেগাহার্টজ স্পেকট্রামের ভিত্তিমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২৩৭ কোটি টাকা।

১০% আগাম, বাকিটা কিস্তিতে

নিলামে বিজয়ী অপারেটরদের ১০ শতাংশ আগাম জমা দিতে হবে। বাকি ৯০ শতাংশ পরিশোধ করতে হবে নয়টি সমান বাৎসরিক কিস্তিতে। প্রথম কিস্তি জমা পড়ার পর বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) স্পেকট্রাম বরাদ্দপত্র দিতে পারবে।

এ ছাড়া, আবেদন প্রক্রিয়াকরণের জন্য ১৫ লাখ টাকা অ-ফেরতযোগ্য ফি এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ১ কোটি টাকা বিড আর্নেস্ট মানি জমা দিতে হবে। নিলাম থেকে পাওয়া সব অর্থ টেলিযোগাযোগ আইনের আওতায় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হবে।

১৮ বছরের আইনি জটিলতার অবসানের পথে

দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে নানা বিতর্ক, মামলা ও আইনি জটিলতায় আটকে ছিল ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ড—যা বিশ্বব্যাপী ‘গোল্ডেন ব্যান্ড’ হিসেবে পরিচিত এর বিস্তৃত কভারেজ ও ঘরের ভেতরে শক্তিশালী সিগন্যাল প্রবেশক্ষমতার জন্য।

২০০৭ সালে বিটিআরসি মাত্র ১২ মেগাহার্টজ ব্যান্ড বরাদ্দ দেয় অপরিচিত আইএসপি অলওয়েজ অন নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ লিমিটেডকে খুবই নামমাত্র মূল্যে। পরে আইটিইউ ব্যান্ডটিকে মোবাইল ব্রডব্যান্ডের জন্য অনুমোদন দিলে সরকার বরাদ্দ বাতিল করে। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠানটি আদালতে গেলে বিষয়টি আপিল বিভাগ পর্যন্ত গড়ায়। এখনো মামলা চলমান থাকায় প্রায় ২০ মেগাহার্টজ ব্যান্ড ‘জমাট’ অবস্থায় পড়ে আছে, বিলম্ব হচ্ছে ৪জি বিস্তৃতি ও পরবর্তী ৫জি প্রস্তুতিতে।

বিটিআরসি বলছে, জটিলতায় পড়ে দেশে বহু সম্ভাব্য আয় হাতছাড়া হয়েছে।

অপারেটরদের সতর্কতা: ‘মূল্য বেশি, ব্যান্ড কম’

২০২৫ সালের নিলাম সামনে রেখে মোবাইল অপারেটরগুলো বলছে, রিজার্ভ মূল্য অত্যধিক; তার ওপর সম্পূর্ণ ২×৪৫ মেগাহার্টজ ছাড়া মাত্র ২×২৫ মেগাহার্টজ ছাড়লে প্রতিযোগিতা অস্বাভাবিকভাবে বাড়বে এবং মূল্য অযথা বাড়তে পারে। আরও উল্লেখ করা হয়, বর্তমান ৪জি ডিভাইসের মাত্র ৬০% এই ব্যান্ড সমর্থন করে, ফলে বিনিয়োগের প্রভাব তাৎক্ষণিকভাবে গ্রাহক পর্যায়ে পৌঁছাবে না।

গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংকের বিদেশি শেয়ারহোল্ডাররা যৌথ চিঠিতে সতর্ক করেছেন, প্রস্তাবিত মূল্যায়ন “অত্যধিক আগ্রাসী”, যা বিনিয়োগ আকর্ষণকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।

‘কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধির ঝুঁকি’ — অভিযোগ শিল্পখাতে

রবি আজিয়াটার চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার শাহেদ আলম বলেন, “মূল্য নির্ধারণে বাজার প্রতিযোগিতা ও গ্রাহকের সামর্থ্য—দুই মূল বিষয় উপেক্ষিত হয়েছে।”

তিনি দাবি করেন, ঐতিহাসিক ৯০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ডের ভিত্তিতে মূল্য নির্ধারণ যুক্তিযুক্ত নয়, কারণ ৯০০ MHz প্রায় সব ফোনে ব্যবহারযোগ্য হলেও ৭০০ মেগাহার্টজ গ্রহণযোগ্য ডিভাইস মাত্র ৬০ শতাংশ।

তিনি বিটিআরসির ভ্যাট রসিদ না দেওয়ার বিষয়েও আপত্তি জানান, যা অপারেটরদের খরচ বাড়ায়।

বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার তৈমুর রহমান বলেন, “আমাদের দেশের খুব কম গড় গ্রাহক আয়ের তুলনায় এই মূল্য অসামঞ্জস্যপূর্ণ।” তিনি জিএসএমএ–এর গবেষণা উদ্ধৃত করে বলেন, ডিজিটাল সংযোগ বাড়াতে সাশ্রয়ী স্পেকট্রাম অপরিহার্য।

টেলিটকের জন্য বরাদ্দের প্রস্তাব নিয়ে নতুন বিতর্ক

সরকার ইঙ্গিত দিয়েছে, আদালতের নিষ্পত্তির পর অবশিষ্ট ১০ মেগাহার্টজ টেলিটকের জন্য সংরক্ষণ করা হতে পারে। বেসরকারি অপারেটররা দাবি করছে, উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার বাইরে এমন উচ্চমূল্যের ব্যান্ড বরাদ্দ দিলে বাজার বিকৃতি ঘটবে। সরকার বলছে, টেলিটককে শক্তিশালী করা প্রয়োজন—জনস্বার্থের সংযোগ নিশ্চিত করতে।

নিলামের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে অপারেটরদের আগ্রহে

আর্থিক শর্ত নির্ধারণ হওয়ায় এখন বিটিআরসি নিলাম প্রস্তুতি চূড়ান্ত করবে। তবে অপারেটররা বলছে, মূল্য কমানো, পূর্ণ ব্যান্ড মুক্ত করা এবং ডিভাইস ইকোসিস্টেম উন্নয়নের নিশ্চয়তা ছাড়া আগ্রহ কমে যেতে পারে। মামলা ঝুলে থাকায় পুরো ব্যান্ড না ছাড়লে স্থাপন ব্যয়ও বাড়বে।

তবুও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ৭০০ মেগাহার্টজ ব্যান্ড মুক্তি বাংলাদেশের টেলিকম খাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। সঠিক মূল্যায়ন ও নীতিনির্ধারণ নিশ্চিত করা গেলে এ ব্যান্ড দেশের কভারেজ উন্নয়ন, গ্রামীণ সংযোগ বৃদ্ধি এবং ভবিষ্যৎ ৫জি অবকাঠামোর ভিত্তি তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখবে।