বাংলাদেশ ব্যাংক ছয়জন প্রভাবশালীর তালিকা করেছে এবং তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশে পাচার করা অর্থের তদন্ত ও মামলাগুলোর নিষ্পত্তি দ্রুততর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তদন্তকারীরা যেসব সন্দেহভাজন ব্যবসায়ীর নাম উল্লেখ করেছেন, সেগুলো হলো নাসা, বেক্সিমকো, সাইফুজ্জামান, সিকদার গ্রুপ, এস. আলম এবং ওরিয়ন।
গত বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক এনপিএল (খেলাপি ঋণ) সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করেছে, যেখানে দেখা যায় ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী মোট অনাদায়ী ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ডিসেম্বর মাসে খেলাপি ঋণ আরও বাড়তে পারে এবং ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে কমতে শুরু করবে।
তিনি বলেন, “বড় ব্যবসায়ীরা অর্থ পাচার করায় খেলাপী ঋণ ফুলে উঠেছে। এই ক্ষত সারাতে হবে,”—যা তালিকার বড় মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তির ইঙ্গিত দেয়।
হাসিনা সরকার পতনের পর ব্যাংকঋণের মাধ্যমে অর্থ পাচারের ঘটনা না থাকায়, ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে খেলাপীর এই বৃদ্ধি কমে আসবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরি হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধারবিষয়ক উপদেষ্টা ফারহানুল গনি চৌধুরী বলেন, খেলাপী ঋণের তথ্য এবং বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তথ্যের ভিত্তিতে ছয়টি ব্যবসায়ী গ্রুপকে দ্রুত বিচার প্রক্রিয়ার জন্য বাছাই করা হয়েছে।
তত্য সংগ্রহ করা হয়েছে ৩০ জুন পর্যন্ত ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি) থেকে।
তিনি বলেন, “জেআইটি এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের সম্পদ—যার ৯০ শতাংশ দেশীয়—জব্দ করেছে, যা এসব লক্ষ্যবস্তু গোষ্ঠীর।”
খেলাপি ঋণের তথ্য ও গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পূর্বে নির্বাচিত ১১টি মামলার মধ্য থেকে ছয়টি গ্রুপকে বিদেশে থাকা সম্পদ উদ্ধারের জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকা করা হয়েছে।
তিনি জানান, ক্ষতিগ্রস্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নিজ নিজ খেলাপী ঋণ পুনরুদ্ধারের জন্য সিভিল প্রসিডিংসে যেতে উৎসাহিত করা হচ্ছে, এবং প্রথম ধাপ হলো আন্তর্জাতিক ল ফার্মগুলোর সঙ্গে নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (এনডিএ)-এ সই করা। ইতোমধ্যে ইউসিবিএলসহ কয়েকটি ব্যাংক সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সম্পদ পুনরুদ্ধারের বিষয়ে আন্তর্জাতিক ফার্মের সঙ্গে এনডিএ সই করেছে।
জেআইটি দল সম্প্রতি আটটি ব্যাংকের প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেছে, যাতে প্রতিটি কনসোর্টিয়ামের জন্য একটি লিড ব্যাংক নির্ধারণ করা যায় এবং এনডিএ প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন হয়। তিনি স্পষ্ট করেন, আন্তর্জাতিক ল ফার্মগুলো লিটিগেশন ফান্ডার নিয়োগ করবে যারা সম্ভাব্য পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা যাচাই করবে এবং ব্যাংকগুলোর কোনো বাড়তি খরচ লাগবে না।
এই বিদেশি সম্পদ পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে তাদের খেলাপী ঋণের অনুপাত অনুযায়ী ভাগ করে নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, স্থানীয় আদালতে ইতোমধ্যে যেসব ফৌজদারি মামলা হয়েছে সেগুলোর সময়সীমা অনুমান করা সম্ভব, কিন্তু যেগুলো এখনো হয়নি, সেগুলোর সময়সীমা অনুমান করা যাচ্ছে না—এটাই স্বাভাবিক তদন্তপ্রক্রিয়া।
চৌধুরী বলেন, বড় বড় আন্তর্জাতিক অপরাধ মামলার উদাহরণ দেখলে দেখা যায় মামলা নিষ্পত্তিতে পাঁচ থেকে দশ বছর সময় লাগে।
“আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে। ফৌজদারি মামলায় কারও দণ্ড চাইলে শক্ত ভিত্তি ছাড়া এগোনো যায় না।”
বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল (সিআইসি) এবং অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সমন্বয়ে গঠিত উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন জেআইটি পূর্বে নির্বাচিত ১১ জন ব্যবসায়ীর মধ্যে ছয়টি মামলাকে জাতীয় নির্বাচনের (আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারিত) আগেই দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখাতে বেছে নিয়েছে।
অন্যান্য সন্দেহভাজনদের মধ্যে শেখ হাসিনার মামলা সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি দেখিয়েছে।
বাকি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রয়েছে নাবিল গ্রুপ, সামিট গ্রুপ এবং এইচবিএম ইকবাল। তবে তথ্য সংগ্রহে কম অগ্রগতির কারণে তারা সম্পদ পুনরুদ্ধারের পরবর্তী পর্যায়ে থাকবে।
ড. ইউনুস সরকারের গঠিত হোয়াইট পেপার প্যানেল অনুমান করেছে, হাসিনা সরকারের সময় প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে—যার বড় অংশ হয়েছে ব্যাংক বোর্ড নিয়ন্ত্রণ করে জাল ঋণ নেওয়া অথবা অবকাঠামো প্রকল্পের অর্থ লুটের মাধ্যমে।
এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক ১৪টি বাণিজ্যিক ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছিল ব্যবসায়ীদের বিদেশে পাচার করা আমানতের অর্থ পুনরুদ্ধারে উদ্যোগ নিতে।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, তারা নভেম্বর মাসে কর ফাঁকি ও দুর্নীতি সম্পর্কিত আরও কিছু মামলা শুরু করতে পারে।
ড. মনসুর আশা প্রকাশ করেছেন যে যুক্তরাজ্য থেকে সাইফুজ্জামানের সম্পৃক্ত কিছু চুরি হওয়া অর্থ ফেরত আনা সম্ভব হতে পারে।
জেআইটি তদন্তের নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই, কারণ এসব তদন্ত জটিল প্রকৃতির।
দুদক ইতোমধ্যে মামলা করা শুরু করেছে, কিন্তু মোট কতটি মামলা করতে হবে তা এখনো নিশ্চিত নয়, কারণ প্রতিদিন নতুন নতুন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এই মুহূর্তে পুরো চিত্র নির্ধারণ করা কঠিন।
তারা একের পর এক তথ্যচক্র পাচ্ছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অর্থের পরিমাণ বিশাল। তাই সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ তথ্য ছাড়া মামলা করা সম্ভব নয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিদেশে থাকা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সম্পদ লক্ষ্য করে আন্তর্জাতিক মামলা পরিচালনার জন্য ১০০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত তহবিল সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছে।
এর আগে সিডনিভিত্তিক লিটিগেশন ফান্ডার ওমনি ব্রিজওয়ে ফিনান্সিয়াল টাইমসকে (এফটি) নিশ্চিত করেছে যে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের নেতৃত্বে ১৬টি ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
ওমনি ব্রিজওয়ের এনফোর্সমেন্ট ব্যবস্থাপনা পরিচালক উইগার ভিলিঙ্গা বলেন, “বিদেশে অবৈধভাবে স্থানান্তরিত অর্থ সংশ্লিষ্ট এনপিএল পুনরুদ্ধার মামলাগুলোতে অর্থায়নে আমরা আগ্রহী।”
২০২৫ সালের ২৪ নভেম্বর, ঢাকার একটি আদালত নাসা গ্রুপ চেয়ারম্যান নাজরুল ইসলাম মজুমদারের মালিকানাধীন ৪৪৭.৮ মিলিয়ন টাকার সম্পত্তি—যার মধ্যে রয়েছে গুলশানে ৩৯.৭৫-কাঠার একটি প্লট এবং ৪৮৭ ডিসিমাল জমি—জব্দের আদেশ দিয়েছে।
এছাড়া, যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস-চেয়ারম্যান সালমান এফ. রহমানের দুই ছেলের মালিকানাধীন লন্ডনের প্রায় ১১০ মিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি ফ্রিজ করেছে। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর যুক্তরাজ্যে থাকা আটটি কোম্পানিও ফ্রিজ করা হয়েছে।
এস. আলম গ্রুপের সম্পদ ছয়টি দেশে এবং একটি শীর্ষ গ্রুপের সম্পদ পাওয়া গেছে আটটি দেশে।











