ঢাকা || ০১ নভেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন বাড়াতে সরকারের কাছে ব্যাপক সংস্কার প্রস্তাব

বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন বাড়াতে সরকারের কাছে ব্যাপক সংস্কার প্রস্তাব

ব্যাংক ইনফো

প্রকাশিত: ০৯:৫৮, ১ নভেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশ ব্যাংক তার স্বায়ত্তশাসনকে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে ও রাজনৈতিক প্রভাব থেকে প্রতিষ্ঠানটিকে সুরক্ষা দিতে সরকারের কাছে একগুচ্ছ ব্যাপক সংস্কার প্রস্তাব পাঠিয়েছে।

অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের কাছে প্রেরিত ৯ অক্টোবর তারিখের একটি ডেমি-অফিশিয়াল চিঠিতে গভর্নর আহসান এইচ. মনসুর বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ১৯৭২-এর খসড়া সংশোধনী তুলে ধরেন। চিঠির অনুলিপি অর্থ সচিব এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছেও পাঠানো হয়েছে।

বিস্তারিত যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যাসহ প্রস্তাবগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেতৃত্বের মর্যাদা বৃদ্ধি, বোর্ড পুনর্গঠন এবং শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়োগ–অপসারণ প্রক্রিয়ার ওভারহল অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক ১৬ সেপ্টেম্বর বোর্ড সভায় খসড়া সংশোধনী উপস্থাপন করে এবং তা অধ্যাদেশ আকারে জারি করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়।

গভর্নর চিঠিতে লিখেছেন, “এই সংশোধনীগুলোর মাধ্যমে আর্থিক খাতে অতীতের ভুল ও অনিয়মের পুনরাবৃত্তি রোধে একটি শক্তিশালী আইনগত ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করা হবে।”

তিনি আরও উল্লেখ করেন, অতীতের সংস্কার প্রচেষ্টা “রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সদিচ্ছার অভাবে” ব্যর্থ হয়েছিল। বর্তমান সময়টি “সবচেয়ে উপযুক্ত” বলে অভিহিত করে তিনি এটিকে সরকারের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য অবদান হিসেবে চিহ্নিত করেন।

চিঠিতে বলা হয়েছে, উন্নত ও আঞ্চলিক অর্থনীতির চর্চা থেকে নেওয়া মোট নয়টি সংশোধনী প্রস্তাব ২০২৫ সালের বাংলাদেশ ব্যাংক (সংশোধনী) অধ্যাদেশ পাসের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরও স্বাধীন ও আধুনিক নজরদারি ক্ষমতা দিতে ভূমিকা রাখবে। এগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের চলমান সংস্কারের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।

আইএমএফ—যারা ৫.৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচির আওতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন জোরদারের ওপর চাপ দিয়ে আসছে এবং সংশোধনী প্রণয়নে কারিগরি সহায়তাও দিয়েছে—তারা এই প্রস্তাবগুলো উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনের জন্য সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা নির্ধারণ করেছিল, যা ইতোমধ্যে পেরিয়ে গেছে।

মনসুর বলেন, সংস্কারের কারণ এবং “কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তি” স্পষ্ট করতে তিনি চিঠিটি লিখেছেন। ১০ অক্টোবর আইএমএফ–বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সভায় যোগ দিতে দেশ ছাড়ার কারণে সরকারের সঙ্গে তার আনুষ্ঠানিক আলোচনার সুযোগ হয়নি; তিনি এ সপ্তাহে দেশে ফিরবেন।

প্রস্তাবগুলো উচ্চাভিলাষী কি না—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমি একে মোটেও উচ্চাভিলাষী মনে করি না; এটি অনেক আগেই করা দরকার ছিল।”

অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবে কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার চাইলে অবশ্যই পারবে।

আইএমএফ-এর শর্তের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “নভেম্বরের আগে উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন আদায়ের সর্বাত্মক চেষ্টা করব। সরকার না চাইলে সেটা তাদের বিষয়।”

নিয়োগ ও অপসারণ প্রক্রিয়া

চিঠিতে গভর্নর প্রস্তাব করেন—গভর্নর ও উপ-গভর্নর নিয়োগের জন্য তিন সদস্যের একটি সার্চ কমিটি গঠন করা হোক। কমিটির নেতৃত্ব দেবেন সাবেক অর্থ বা পরিকল্পনামন্ত্রী/উপদেষ্টা, অথবা সাবেক বা বিদায়ী গভর্নর। কমিটির কার্যপরিধি নীতিমালায় নির্ধারিত থাকবে।

প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য হলো রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, যোগ্যতাভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিত করা, যা “একটি আধুনিক ও স্বায়ত্তশাসিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মৌলিক শর্ত,” বলে তিনি লিখেছেন।

তিনি ব্যাংক অব ইংল্যান্ড, রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, ব্যাংক অব কানাডা, সাউথ আফ্রিকান রিজার্ভ ব্যাংক এবং ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংকের উদাহরণ তুলে ধরেন।

শীর্ষ কর্মকর্তাদের অপসারণসংক্রান্ত অভিযোগ পরীক্ষা করবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের এক বিচারপতির নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ‘কোর্ট অব ইনকোয়ারি’। এর মাধ্যমে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া কাউকে অপসারণ করা যাবে না।

চিঠিতে বলা হয়, ব্যাংক অব ইংল্যান্ডসহ বিশ্বব্যাপী—অসদাচরণ বা অক্ষমতার প্রমাণ সাপেক্ষে আইন অনুযায়ী অপসারণই প্রচলিত প্রথা।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান প্রস্তাবিত সংশোধনীকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন জোরদারের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হিসেবে অভিহিত করেন। তবে তিনি মনে করিয়ে দেন, প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন শেষ পর্যন্ত নির্ভর করবে গভর্নরের ব্যক্তিত্ব, স্বাধীন মনোভাব ও সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের ওপর।

বোর্ড পুনর্গঠন

চিঠিতে বোর্ডে সরকারের মনোনীত পরিচালক সংখ্যা তিন থেকে কমিয়ে এক করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অন্যদিকে স্বাধীন বিশেষজ্ঞ সদস্য সংখ্যা চার থেকে বাড়িয়ে ছয় করার প্রস্তাব রয়েছে, যা নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ার স্বাধীনতা শক্তিশালী করবে।

চিঠিতে বলা হয়, ব্যাংক অব ইংল্যান্ডসহ অনেক শীর্ষ কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূলত স্বাধীন সদস্যনির্ভর বোর্ডে পরিচালিত হয়। ইংল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বোর্ডে ১২ সদস্য, যার মধ্যে রয়েছেন গভর্নর, দুই উপ-গভর্নর এবং নয়জন নন-এক্সিকিউটিভ সদস্য।

বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ডে আট সদস্য—গভর্নর, এক উপ-গভর্নর, তিন সচিব, দুই অর্থনীতিবিদ এবং একজন ব্যবসায়ী নেতা।

গভর্নরের মর্যাদা

প্রস্তাব অনুযায়ী, গভর্নরের পদমর্যাদা পূর্ণ মন্ত্রীর সমান করা হবে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাই-ল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা এবং ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রধানদের সমমর্যাদা বিবেচনায় এটি নীতিনির্ধারণে স্বাধীনতা ও কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সহায়ক বলে উল্লেখ করা হয়।

এটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিনিধিত্ব এবং অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে কার্যকর সমন্বয় নিশ্চিত করবে।

নতুন নজরদারি ক্ষমতা

গভর্নর মনসুরের প্রস্তাবে নতুন কয়েকটি ধারা যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে—যেমন হুইসেলব্লোয়ার সুরক্ষা, একচেটিয়া ব্যবসা প্রতিরোধ, ক্রেডিট রেটিং এজেন্সির তদারকি, জামানত মূল্যায়ন ও আইনগত যাচাই-বাছাই।

এগুলো ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়াতে এবং অনিয়ম, দুর্নীতি, তথ্য গোপন, স্বজনপ্রীতি ও একচেটিয়া আচরণ রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বিশ্বব্যাংকের ২০২২ সালের গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ডেভেলপমেন্ট রিপোর্টে দুর্নীতি ও নৈতিক ঝুঁকি প্রতিরোধে হুইসেলব্লোয়ার সুরক্ষাকে অত্যন্ত কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।