
২০২৪ সালে দেশের ব্যাংকিং খাতে এক অনন্য মাইলফলক স্থাপন করেছে দেশীয় মালিকানাধীন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সিটি ব্যাংক। গত বছর ব্যাংকটি সমন্বিতভাবে ১,০১৪ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছে যা এখন পর্যন্ত ব্যাংকের ৪২ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
সিটি ব্যাংক এককভাবে ১,০৮৫ কোটি টাকা নিট মুনাফা অর্জন করলেও, সহযোগী দুটি প্রতিষ্ঠানের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের বাজারমূল্য হ্রাস পাওয়ায় প্রভিশন ব্যয় হওয়ার কারণে ব্যাংকের সমন্বিত নিট মুনাফা কমে ১,০১৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
২০২৩ সালে ব্যাংকটির সমন্বিত নিট মুনাফা ছিল ৬৩৮ কোটি টাকা। সে তুলনায় ২০২৪ সালে সমন্বিত মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৭৬ কোটি টাকা বা ৫৯ শতাংশ—যা সিটি ব্যাংকের ইতিহাসে এক বছরে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি।
ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কেবল প্রতিষ্ঠানগত সাফল্য নয়, সিটি ব্যাংকের এই অর্জন বাংলাদেশের ব্যাংক খাতেও একটি রেকর্ড। অতীতে কোনো দেশীয় কনভেনশনাল ব্যাংক ১,০০০ কোটি টাকার ওপরে নিট মুনাফা করতে পারেনি। এর একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছে ব্র্যাক ব্যাংক, যারা গতকাল ১,৪৩২ কোটি টাকার নিট মুনাফার ঘোষণা দিয়েছে।
মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত পরিচালনা পর্ষদের সভায় ২০২৪ সালের আর্থিক প্রতিবেদন অনুমোদন করে ব্যাংকটি। সেই সঙ্গে ঘোষণা করা হয় ২৫ শতাংশ লভ্যাংশ, যার মধ্যে ১২.৫ শতাংশ নগদ এবং ১২.৫ শতাংশ বোনাস। গত বছরও একই হারে লভ্যাংশ দিয়েছিল সিটি ব্যাংক। শেয়ারধারীদের অনুমোদনের পর এই লভ্যাংশ বার্ষিক সাধারণ সভায় বিতরণ করা হবে। ঘোষিত নগদ লভ্যাংশে ব্যয় হবে প্রায় ১৭০ কোটি টাকারও বেশি। পাশাপাশি বোনাস হিসেবে প্রতি ১০০ শেয়ারের বিপরীতে ১২.৫টি নতুন শেয়ার দেওয়া হবে।
রেকর্ড মুনাফার প্রভাব পড়েছে ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি আয়েও (EPS)। ২০২৩ সালের ৪.৭৪ টাকার তুলনায় ২০২৪ সালে ইপিএস বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭.৫৩ টাকায়, অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি ৫৮.৯ শতাংশ। একইভাবে শেয়ারপ্রতি প্রকৃত সম্পদমূল্য (NAV) বেড়ে হয়েছে ৩৪.৩৯ টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ৫.৩৮ টাকা বা ২০.৪১ শতাংশ বেশি।
রেকর্ড মুনাফার কারণ জানতে চাইলে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বলেন, ‘মানুষ আমাদের ওপর আস্থা রেখে আমানত রেখেছে। আয়-ব্যয়ের অনুপাত ৬০ শতাংশ থেকে কমে ৪২ শতাংশে নেমে এসেছে। ফলে মুনাফায় বড় উল্লম্ফন ঘটেছে। আমরা কর্মীদের বেতন বাড়িয়ে ৩০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করেছি, যা কর্মীদের উৎসাহিত করেছে। আমাদের পরিচালনা পর্ষদ সৎ ও মেধাবী। ব্যাংকে ঈর্ষণীয় পর্যায়ের সুশাসন বিদ্যমান। এসবই রেকর্ড মুনাফার পেছনের মূল কারণ।’
২০২৪ সালে ব্যাংকের আমানত বেড়েছে ৩১ শতাংশ বা ১২,১৭৭ কোটি টাকা, যেখানে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১২ শতাংশ বা ৪,৮৩১ কোটি টাকা। এই উদ্বৃত্ত তহবিলের বড় একটি অংশ সরকারি সিকিউরিটিজে বিনিয়োগ করা হয়েছে, যা আগের বিনিয়োগ থেকে ৬,১৫০ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২,৪৮৮ কোটি টাকায়।
সিটি ব্যাংকের আয়ের উৎস বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মোট আয়ের ৬৪ শতাংশ এসেছে ঋণ থেকে পাওয়া সুদ থেকে, ১২ শতাংশ এসেছে ফি ও এলসি কমিশন থেকে এবং ১৯ শতাংশ ট্রেজারি বিল-বন্ড থেকে। বাকি ৫ শতাংশ এসেছে বন্ড, ডিভিডেন্ড এবং শেয়ারবাজার থেকে। অর্থাৎ ব্যাংকটির আয়ের ৭৬ শতাংশই এসেছে মূল ব্যাংকিং কার্যক্রম থেকে, যা ঋণ-ভিত্তিক ব্যবসায় তাদের নির্ভরতা ও দক্ষতা নির্দেশ করে।
তাছাড়া, বছর শেষে শেয়ারপ্রতি নগদ অর্থপ্রবাহ (cash flow per share) বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬৬.৪৪ টাকা, যা ২০২৩ সালে ছিল মাত্র ২.৯০ টাকা—অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি প্রায় ২৩ গুণ।
এই সবকিছু মিলিয়ে বলা যায়, ২০২৪ সালটি সিটি ব্যাংকের ইতিহাসে শুধু একটি সফল বছর নয়, বরং এটি বাংলাদেশের ব্যাংক খাতের জন্যও একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।