
ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের আমদানি অংশে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দেশের রপ্তানিমুখী শিল্পে বড় ধাক্কা লেগেছে। এতে তৈরি পোশাক শিল্পসহ ওষুধ ও টেলিকম খাতের সরবরাহ শৃঙ্খল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। শিল্পসংশ্লিষ্টদের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, ক্ষতির পরিমাণ এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
রপ্তানিকারকরা জানিয়েছেন, আগুনে আমদানি করা নমুনা ও উৎপাদনের বিভিন্ন উপকরণ পুড়ে যাওয়ায় চলমান ও ভবিষ্যতের উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। এতে বড়দিনের বিক্রির মৌসুমের জন্য নির্ধারিত চালান বিলম্বিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) পরিচালক ফয়সাল সামাদ বলেন, ‘রপ্তানি অংশ অক্ষত থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ নমুনা নষ্ট হয়ে গেছে। এতে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা অর্ডার বাতিল বা নবায়ন না-ও করতে পারেন, যা পুরো খাতে বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলবে।’
তিনি জানান, সরকার সাময়িকভাবে বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালে গুদামের জায়গা বরাদ্দ দিয়েছে, যাতে দ্রুত পুনরুদ্ধার কার্যক্রম চালানো যায়।
বিজিএমইএর সিনিয়র সহসভাপতি ইনামুল হক খান বলেন, ‘আমরা সদস্যদের ক্ষতির তথ্য সংগ্রহ করছি। বাণিজ্য উপদেষ্টা এস কে বশির উদ্দিন সরকারিভাবে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন।’ তিনি দ্রুত সরকারি তদন্তের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘বিমানবন্দরের সংবেদনশীল এলাকাগুলোর নিরাপত্তা না বাড়ালে বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা পুনরুদ্ধার কঠিন হবে।’
পোশাক শিল্পের পাশাপাশি ওষুধ ও টেলিকম খাতও ক্ষতিগ্রস্ত
হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মুহাম্মদ হালিমুজ্জামান বলেন, ‘এই অগ্নিকাণ্ডের কারণে দেশের ওষুধ শিল্পে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বড় বড় ওষুধ কোম্পানির সময়নির্ভর কাঁচামাল নষ্ট হয়েছে।’
তিনি সরকারের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করে বলেন, ‘ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অনুমোদন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করলে ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।’
স্যালভেশন লজিস্টিকসের কাস্টমস কোঅর্ডিনেটর মিজানুর রহমান জানান, তাদের ৪০টি চালানের সব টেলিকম যন্ত্রাংশ পুড়ে গেছে। ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১০ লাখ টাকা।
জেন ট্রেডিং লিমিটেডের বেলাল হোসেন বলেন, ‘আমাদের ক্লায়েন্টদের প্রায় ২০০ কোটি টাকার পণ্য আগুনে নষ্ট হয়েছে।’
মাতাতা ট্রেডিং কোম্পানির ইনচার্জ মোহাম্মদ রফিক বলেন, ‘২৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার উচ্চমূল্যের মোবাইল যন্ত্রাংশ পুড়ে গেছে—এসব ওপ্পো, শাওমি, স্যামসাং, ওয়ানপ্লাসের মতো ব্র্যান্ডের জন্য নির্ধারিত ছিল।’
আগুনে বিলম্বে ক্ষয়ক্ষতি বাড়ার অভিযোগ
ঢাকা কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অভিযোগ করেছে, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ ও ফায়ার সার্ভিস সময়মতো সাড়া না দেওয়ায় ক্ষতির পরিমাণ এত ভয়াবহ হয়েছে। সংগঠনটির বিবৃতিতে বলা হয়, ‘সিভিল এভিয়েশন ও ফায়ার সার্ভিসের সমন্বয়ের ঘাটতির কারণেই এই অপূরণীয় ক্ষতি ঘটেছে।’
তবে বাণিজ্য উপদেষ্টা এস কে বশির উদ্দিন বলেন, ‘আগুন লাগার খবর পাওয়ার ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই দমকল বাহিনী কাজ শুরু করে। ৩৭টি ইউনিট আগুন নেভাতে অংশ নেয় এবং ওয়াসা অতিরিক্ত পানি সরবরাহ করে।’
রপ্তানি ও আমদানি কার্যক্রমে চাপ বাড়ছে
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএএফএফএ) সাবেক সহসভাপতি নুরুল আমিন বলেন, ‘আগুনে বিপুল পণ্য আটকে যাওয়ায় এ বছর বিমান পরিবহনে চাপ আরও বেড়ে যাবে।’
তিনি জানান, চট্টগ্রাম বন্দরে ধর্মঘটের কারণে অনেক পণ্য আগেই শাহজালালে স্থানান্তর করা হয়েছিল। এখন পুড়ে যাওয়া উপকরণ দ্রুত প্রতিস্থাপন করতে হবে, যা আবারও কার্গো ভিলেজে জট বাড়াবে।
প্রতিদিন বিমানবন্দরে প্রায় এক হাজার টন শুকনো পণ্য ব্যবস্থাপনা করা হয়, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই পরিমাণ আরও বেড়ে যায়।
বিজিএমইএ সদস্যদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে আমদানি করা সব মালামাল বিমানবন্দর থেকে সরিয়ে নিতে। পাশাপাশি সরকার পুরো প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্নের জন্য কার্গো ভিলেজকে সপ্তাহজুড়ে ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার নির্দেশ দিয়েছে।
ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ
আগুনের এই ঘটনা গত এক সপ্তাহে দেশের তৃতীয় বড় শিল্প দুর্ঘটনা। এর আগে চট্টগ্রাম বন্দরে শুল্কজট, ঋণের সুদ বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি ও ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসে ব্যবসায়ীরা আগেই বিপাকে ছিলেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ, যা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতা আরও কঠিন করে তুলেছে।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শাহজালালের এই আগুন শুধু দেশের ভাবমূর্তিই ক্ষুণ্ন করেনি, বরং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোকেও সুবিধা দিয়েছে।